টাঙ্গাইলে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা ও মাদকসেবন বেড়েছে!

অপরাধ টাঙ্গাইল সদর ফিচার রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল শহরে সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ার সঙ্গে তারা মাদক সেবনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এর ফলে এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দিন দিন ভয়ংকর হয়ে ওঠে নানাবিধ অপকর্ম করছে বলে জানা গেছে।

 

 

 

অভিযোগে জানা যায়, শহরের ক্যাপসুল মার্কেট, সবুর খান টাওয়ারের সামনের রাস্তা, ছয়আনি পুকুর পাড়, টাঙ্গাইল সরকারি বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের বড় পুকুর পাড়, শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যানের পেছনের নজরুল সেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাসহ পুরো গলি, টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ ময়দানের বাঁশ বাজার, পরিত্যক্ত ভাসানী হল চত্বরসহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে এরা দলবেঁধে মিলিত হয়। পরে শহর জুড়ে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া চালায়।

এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন নামে গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রাখে। কোনো ঘটনা ঘটলেই এইসব গ্রুপের মাধ্যমে মুহূর্তেই সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায় সেই খবর। এইসব ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে কোথায় মিলিত হতে হবে, অপারেশন করতে হবে- এমন নির্দেশনাও পেয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট গ্রুপের সদস্যরা।

সম্প্রতি পৌর শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা। ফলে প্রায় প্রতিদিনই কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষ বেঁধে ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো ঘটনা।

এছাড়া এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক সেবনের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। তারা জেলা সদরের সৌখিন মৎস্য শিকারি সমিতির আশপাশ এলাকা, পৌর এলাকার শামসুল হক মার্কেটের ২য় তলার খালি অংশ, টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ ময়দানের বাঁশ বাজার, মালঞ্চ সিনেমা হলের আশপাশের এলাকা, শহরের শামসুল হক তোরণ, সরকারি গ্রন্থাগার, কোদালিয়া, নতুন বাস টার্মিনালের পেছনের লেকপাড়, বেড়াডোমা এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন চিহ্নিত স্পট থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক সংগ্রহ করে প্রকাশ্যেই সেবন করছে বলে জানা গেছে। এছাড়া শহরে মাদকের সংকট হলেই তারা মাদক সংগ্রহের জন্য মোটর সাইকেলে চলে যাচ্ছে শহরতলীর গালা ইউনিয়নের মনতলা, মগড়া ইউনিয়নের ছোট বাসালিয়া, ঘারিন্দা রেল স্টেশন, সন্তোষ, অলোয়া জমিদার বাড়ির আশপাশের এলাকাসহ বাইপাস এলাকায়।

শুক্রবার (১৫ মার্চ) পৌর শহরের কলেজ গেট এলাকার হাতেম আলীর ছেলে মামুনকে বিশ্বাস বেতকা এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য পিয়াসের নেতৃত্বে গ্যাংয়ের সদস্য রাহাত, ছাব্বির, পাপন, মনির হোসেন, চপল, শাওন, সোহাগ, আবির, আসিফরা তুলে নিয়ে গিয়ে বেদম মারধর করে। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠান হয়। সর্বশেষ তিনি বর্তমানে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় আহতের মা মালেকা বেগম বাদী হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) রাতে টাঙ্গাইল আউটার স্টেডিয়ামে অবস্থিত টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমির ছাত্র তরুণ ফুটবলার মো. সজিব হোসেন (১৮) পৌর শহরের সাবালিয়া এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য নুরু ও তার গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার হন। তার বাম হাত, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় বর্তমানে সে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমির কোষাধ্যক্ষ ও ইনচার্জ রণজিৎ রায় জানান, ইতোমধ্যে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বর্তমানে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

সম্প্রতি ডিসি লেকে বেড়াতে আসা বাসাইলের এক কলেজছাত্র কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। ওই কলেজছাত্র জানান, বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) সকালে সে ও তার এক বান্ধবী ডিসি লেকে বেড়াতে যান। ডিসি লেকের শিশুপার্ক চত্বর থেকে একদল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য তাদের আটক করে পাশের একটি ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে যায়। তাকে ও তার বান্ধবীকে তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে‌। পরে তাদের সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি আরও জানান, ডিসি লেকের পাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি ফাস্টফুডের দোকানদারদের সঙ্গে এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই ডিসি লেকে বেড়াতে যাওয়া নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীরা এই ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় ঈদগাহের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, প্রায় প্রতিদিনই ঈদগাহের পশ্চিম পাশের বকুল গাছের নিচে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের ধরে এনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নির্যাতন চালায়। এসময় তাদের টাকা-পয়সাসহ মোবাইল ফোন রেখে দেওয়া হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই এইসব ঘটনার পেছনে প্রেম সংক্রান্ত বিষয় জড়িত থাকে বলেও তারা জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিশোর গ্যাংয়ের দুই সদস্য জানান, টাঙ্গাইলের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের আশীর্বাদে তাদের গ্যাংয়ে প্রায় ২৫ জন সদস্য রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তারা সেই ভাইয়ের পক্ষ হয়ে নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। তার পরিবর্তে তাদের সেই বড় ভাই বিভিন্ন ঘটনায় তাদের শেল্টার দিয়ে থাকেন।

টাঙ্গাইল অ্যাডভোকেট বার সমিতির সাবেক সভাপতি মইদুল ইসলাম শিশির বলেন, টাঙ্গাইল শহরে ইদানিং কিশোর গ্যাংয়ের বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা রুজি-রোজগারের আশায় আর উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানেরা থ্রিলারের আশায় কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়।

তিনি আরও বলেন, এই কিশোরদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যারা ইতোমধ্যেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে কেউ আর কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহস না পায়।

টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লোকমান হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব সারাদেশে আছে, একই অবস্থা টাঙ্গাইল শহরেও। বিষয়টি আমাদের জানা আছে। যখনই তারা কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গেই সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এটাও সত্য। এ কারণে তাদের দ্বারা অপরাধও বেশি সংঘটিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক বড় ভাইদের হাত থাকে। এই কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমাতে শুধুমাত্র প্রশাসনই নয়, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা এগিয়ে এলে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমিয়ে আনা যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *