
মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের সন্তোষে গণচীন থেকে উপহার পাওয়া ট্রাক্টর, টাইপরাইটারসহ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। অনেক সরঞ্জাম আবার নষ্টও হয়ে যাচ্ছে। এই সরঞ্জামগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন পরিবারের সদস্য, ভক্ত ও অনুসারীসহ স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
সরেজমিন দেখা যায়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম পাশে একটি টিনশেডে রয়েছে ট্রাক্টর ও টাইপরাইটারটি। টিনশেডের চারপাশে স্বচ্ছ কাচ। ট্রাক্টর ও টাইপরাইটার মেশিনটিতে জমেছে ধুলার আস্তরণ। মওলানা ভাসানী ও চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতা মাও জেদংয়ের স্মৃতিবিজড়িত এই ট্রাক্টরের সামনের একটি চাকা নেই। এটি উচ্চতায় ৬ ফুট, লম্বায় ১০ ফুট।
জানা যায়, মওলানা ভাসানী ১৯৬৩ সালে প্রথম এবং ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় বার চীন সফর করেন। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ‘মাও সে-তুঙ এর দেশে’ নামে একটি বইও লেখেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মওলানা ভাসানী তৃতীয় ও শেষবার চীন সফর করেন। সে সময় চীনের নেতা মাও জেদং তাকে একটি ট্রাক্টর উপহার দেন। ১৯৬৭ সালে চীন থেকে ট্রাক্টরটি বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
সমবায় পদ্ধতির কৃষিকাজে ট্রাক্টরটির সাহায্যে একসঙ্গে ৫০ একর জমি চাষ করা যেত। সে সময় মওলানা ভাসানীর কৃষিকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড চলমান ছিল জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মহীপুর এলাকায়। সেখানে ট্রাক্টরটি কিছুদিন কাজে লাগানো হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে ট্রাক্টরটি টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিয়ে আসা হয়। পরে মওলানা ভাসানী ট্রাক্টরটি বসিয়ে না রেখে কাজ করার জন্য বিএডিসিকে দিয়ে দেন। বিএডিসি সেটি জামালপুরে কিছুদিন কাজে লাগায়। জামালপুরে ট্রাক্টরটি একপর্যায়ে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকার পর বিক্রির কথা ওঠে।
১৯৯৫ সালে তৎকালীন সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড ট্রাক্টরটি ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে ট্রাক্টরটি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান সাজু বলেন, মওলানা ভাসানী দলমত নির্বিশেষে আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ; তিনি আছেন আদর্শ, স্মৃতি, ইতিহাস ও কবির কবিতায়। তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এই বঙ্গীয় ‘ব’-দ্বীপে এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়েও যে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করা যায় মওলানা ভাসানী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তার রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন ও প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ধ্বংসের পথে। মজলুম জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর ‘হক কথা’ পত্রিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘শান্তি প্রেস’র ব্যবহার্য সরঞ্জামগুলো আজ অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে; এই স্মৃতি সংরক্ষণে সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারও দায় নেই। মওলানা ভাসানী জাদুঘরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে তার স্মৃতি সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।
ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী সমাপ্তি খান বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন কৃষক ও মেহনতি মানুষের নেতা। তার সংগ্রামী জীবন, চীন থেকে উপহার পাওয়া ট্রাক্টরসহ নানা স্মৃতি আজ আমাদের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব জিনিসপত্র অনেক জায়গায় অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর ব্যবহৃত জিনিস, যেমন-ট্রাক্টর, পোশাক, দলিল, বই ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য একটি স্থায়ী ‘ভাসানী জাদুঘর’ করা উচিত। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাজেট ও তদারকি টিম গঠন করা দরকার। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জীবন ও আদর্শ পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
তার ভাষণ, চিঠিপত্র ও আলোকচিত্র ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ করে অনলাইনে উন্মুক্ত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সহজে জানতে পারবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়মিত মেরামত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করতে হবে। মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক চেতনা তরুণদের মাঝে উজ্জীবিত করতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
