
সখীপুর প্রতিনিধি: সখীপুর উপজেলায় বন বিভাগের তিনটি রেঞ্জের ১১টি বিট কার্যালয়ের আওতাধীন এলাকায় অবৈধভাবে ৪২টি করাতকল স্থাপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংরক্ষিত শাল-গজারি ও সামাজিক বনায়নের ভেতর, বন ঘেঁষে এমনকি বন কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের কাছেই এসব কল স্থাপন করা হয়েছে। এসব করাতকল উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও সখীপুর পৌরসভার বৈধ করাতকল মালিক সমিতির নেতারা কোনো সমাধান পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অথচ বন আইনে করাতকল স্থাপন নিয়ে ৭ এর (ক) ধারা মোতাবেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের বিধান না থাকলেও স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে দিন-রাত এখানে অবাধে চেরানো হচ্ছে শাল-গজারিসহ সংরক্ষিত বনের গাছ। এভাবে প্রতিনিয়ত সংরক্ষিত বনের গাছ চেরাই হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন।
স্থানীয় বন বিভাগের তালিকা থেকে জানা যায়, ৪২টি অবৈধ করাতকলের মধ্যে বহেড়াতৈল রেঞ্জে ২৮টি, হাতিয়ায় ৭টি ও বাঁশতৈল রেঞ্জে ৭টি করাতকল বর্তমানে চালু রয়েছে।
বৈধ করাতকল মালিকদের দাবি, প্রতিটি অবৈধ করাতকলে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ ঘনফুট কাঠ চেরাই হচ্ছে। সেই হিসেবে ওই ৪২টি অবৈধ করাতকলে প্রতিদিন ৮ হাজার ৪০০ ঘনফুট, মাসে দুই লাখ ৫২ হাজার ও এক বছরে ৩০ লাখ ২৪ হাজার ঘনফুট বনের কাঠ চেরাই হচ্ছে।
সরেজমিন বহেড়াতৈল রেঞ্জের কাঁকড়াজান বিট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিটের আনুমানিক ১০০ গজ পশ্চিমে জয়নাল আবেদিন ও উত্তর পাশে সমপরিমান দূরে নূর জামাল দুটি করাতকল স্থাপন করেছেন। নুর জামালের কলে চারজন শ্রমিক কাজ করছে। করাতকলের ডকে একখণ্ড গাছ তুলে দুপাশে দুইজন শ্রমিক চেরাই কাজ করছেন। তাদের সহযোগিতা করছেন আরও দুজন শ্রমিক।
উক্ত দৃশ্যের ছবি তুলতে গেলে করাত কলের মালিক নুর জামাল পেছন দিক থেকে এসে বাধা দিয়ে বলেন, ‘বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই আমরা এসব করাতকল চালাই। ছবি তুলে আপনি কী করবেন?’ বন কার্যালয়ের পাশে করাতকল কীভাবে চলছে- জানতে চাইলে কাঁকড়াজান বিট কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে কোনো কথাই বলতে রাজি হননি।
কাকড়াজান বিটের আওতাধীন বড় হামিদপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে স্থানীয় আনসার আলী নামের এক ব্যক্তি করাতকল স্থাপন করেছেন। ওই সময় বেলা পোনে ১১টার দিকে করাতকলটি বন্ধ অবস্থায় দেখা যায়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে করাতকল স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন স্কুল শুরু হয় তখন আমার কল বন্ধ থাকে।’
বড়হামিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হাশেম বলেন, বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে করাত কলের শব্দে শিশু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। এছাড়াও কাঠের গুড়ো শিশুদের চোখে এসে পড়ে। এরা স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কিছু বলা যায় না।
বহেড়াতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বলেন, আমরা মাঝে মধ্যেই অবৈধ করাত কলগুলো উচ্ছেদ করি। এমনকি অবৈধ কল মালিকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও করেছি। উচ্ছেদ করার এক সপ্তাহ পরেই আবার তারা সেখানেই কল স্থাপন করে। আমাদের ম্যানেজ তো দূরের কথা আমাদের তোয়াক্কাও করে না তারা।
সখীপুর পৌরসভার বৈধ করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি জিন্নত আলী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক মিয়া বলেন, অবৈধ করাতকল বনাঞ্চলে চালু থাকায় বৈধ করাতকলে কাঠ নিয়ে ব্যবসায়ীরা আসেন না। পৌরসভার ভেতরে ৫০টি বৈধ করাতকল রয়েছে। আমরা ব্যবসায়িকভাবে দিন দিন পথে বসতে চলেছি।
সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান লুৎফর রহমান বলেন, এভাবে অবৈধ করাতকলে দিনরাত বনের কাঠ চেরানো হলে আস্তে আস্তে এসব প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ফলে পরিবেশের ওপর এর দারুন প্রভাব ফেলবে। দিন দিন বনায়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় গরমকালে প্রচণ্ড গরম আর শীতকালে ব্যাপক শীত পড়ে।
উপজেলার হাতিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ বলেন, আমি এই রেঞ্জে যোগদান করার পর কমপক্ষে ২৫ টি করাত কল উচ্ছেদ করেছি। এখন মাত্র ৬-৭ টি করাতকল রয়েছে। শিগগিরই এগুলোও উচ্ছেদ করা হবে।
টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান মুঠোফোনে সখীপুরের বনাঞ্চলে অবৈধ করাত কল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, সব সময় আমাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তারপরেও শিগগিরই ওই সব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে।