নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলে তীব্র গরমে মধু মাসের ফল হিসেবে তাল শাঁসের কদর ও চাহিদা বেড়েছে। সব বয়সের মানুষের কাছে এই ফলটি বেশ প্রিয় খাবার। রাস্তার ধারে বা ফুটপাতে বসে থাকা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ভীড় জমিয়ে এই ফল কিনে থাকেন ক্রেতারা।
টাঙ্গাইল শহরের প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে বিক্রেতারা এখন বিক্রি করছেন তাল শাঁস। কোনো কোনো বিক্রেতারা ভ্যানযোগে পাড়া ও মহল্লায় ঘুরে ঘুরে তাল শাঁস বিক্রি করছেন। তীব্র গরমে একটু স্বস্তি পেতে সাধারণ মানুষের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠা তালের নরম কচি শাঁস খেতে সুস্বাদু হওয়ায় গ্রাম থেকে শহরেও এর চাহিদা বেড়েছে।
পশ্চিম আকুর টাকুর এলাকার তাল শাঁস বিক্রেতা মনোহর আলী জানান, প্রতি বছর মধু মাসে জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে তাল ক্রয় করেন। পরে শহরে স্থানীয় শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানের সামনে মোড়ে তা বিক্রি করেন। প্রতি বছরই এ সময় তালের শাঁস বিক্রি করে সংসার চালান। বৈশাখ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠের অর্ধেক সময় পর্যন্ত চলবে তালের শাঁস বিক্রি। তবে এবারে ফলন কম হওয়ায় দাম কিছুটা বাড়তি বলেও জানান তিনি। তবে প্রতি তালের দাম নিচ্ছেন ২০ থেকে ২৫ টাকা। তিনি বলেন, গাছ থেকে তালের কাঁদি কেটে তা আবার নামানো, বাজারে বয়ে আনা, তারপর কাটাকাটি করে তবেই ক্রেতার হাতে দিতে হয়। কষ্ট হলেও বেশ লাভ হয়।
পৌর উদ্দানের বিক্রেতা মফিজুর রহমান জানান, একশত তাল ১৫০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকায় সিজন হিসেবে ক্রয় করেন। পরে সেই তাল গাছ থেকে তাল সংগ্রহ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে মোড়ে মোড়ে বিক্রি করেন। তাল বিক্রি করে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করা যায়। তিনি আরো বলেন, প্রচন্ড গরম থাকায় তাল শাঁসের চাহিদা বেশি। প্রতিটি তালের শাঁসের পিস বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ তাল শাঁস বিক্রি হয়।
পার্ক বাজারের বিক্রেতা আবুল কাশেম জানান, প্রতিটি তাল শাঁস ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন। সৌখিন ক্রেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, পথচারীরা প্রচন্ড গরমে একটু স্বস্তি পেতে ভিড় করছেন তাল শাঁস বিক্রেতাদের কাছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন, আমাদের গ্রামের চেয়ে টাঙ্গাইল শহরে তালের শাঁস দাম একটু বেশি। তবুও এটা মৌসুমি ফল হওয়ার পাশাপাশি পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত ফল।
আশেকপুরের বাসিন্দা ও তাল গাছের মালিক তুহিন সিদ্দিকী জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গাছে ফলের সংখ্যা কমে গেছে। তাই তালের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। আর সর্বত্র ঘরবাড়ী নির্মাণের প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। তবে নতুন করে গাছ বোনা হলে এবং গাছগুলো বড় হলে, ফলন ধরলে এ মৌসুমি ফলের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
শহরের সিডিসি মার্কেটের ব্যবসায়ী বিপ্লব কুমার দাস জানান, তালের শাস একটি সু-স্বাদু ফল। গরম থেকে এসে তালের শাঁস খেতে ভালই লাগে। ফলের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। এক সময় মানুষ শখ করে বাড়ির পাশে কিংবা রাস্তার ধারে তালের বীজ বোপন করতো কিন্তু এখন আর তা চোখে পড়ে না।
কবি নিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উকি মারে আকাশে, কবির সে কবিতার মতো সারি সারি তাল গাছ রাস্তার দুধারে আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে জেলার বিভিন্ন এলাকার তাল গাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
টাঙ্গাইলের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ আব্দুল মতিন বলেন, তালের শাঁস শরীরের জন্য খুবই উপকারী একটি ফল। গরমের দিনে তালের শাঁসে থাকা জলীয় অংশ পানি শূন্যতা দূর করে। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, এ, বিকমপ্লেক্সসহ নানা ধরনের ভিটামিন রয়েছে। আপনার ত্বকের যত্নসহ কচি তালের শাঁস লিভারের সমস্যা, চুল পড়া রোধ দূর করতে সহায়তা করে। তালে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কচি তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূর করে। চোখের দৃষ্টি শক্তি ও মুখের রুচি বাড়ায়।
এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ ড. এম মনিরউদ্দিন বলেন, জেলার কোথাও তাল গাছের বাণিজ্যিক কোনো বাগান নেই। তালগাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ সাধারণত বসত বাড়ি, রাস্তার পাশে তাল গাছ রোপন করে থাকে। সৌন্দর্যের পাশাপাশি তালগাছ লম্বা হওয়ার কারণে বজ্রপাত রোধে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বেশি বেশি তাল গাছ রোপন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আহসানুল বাশার বলেন, এখন বজ্রপাত রোধে বিভিন্ন রাস্তার ধারে ও খালের পাড়ে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে। কৃষি অফিস ও বিভিন্ন সংগঠনের আলাদাভাবে তালের গাছ রোপণ করে আসছে। এ বছর তালের ফলনটা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এছাড়া এবার নতুন নতুন গাছে থেকে তাল ধরেছে। এসব গাছের তাল পাকানোর জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যাতে বীজ করা যায়।