জেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে পরিকল্পনাহীন বিদ্যালয় নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার্থীরা

জেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে পরিকল্পনাহীন বিদ্যালয় নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার্থীরা

টাঙ্গাইল ফিচার

সময়তরঙ্গ ডেক্স: টাঙ্গাইল জেলার নদীকেন্দ্রিক পাঁচটি উপজেলায় নদীপাড়ের শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদী ভাঙনের কবলে রয়েছে। এসব অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো প্রতিবছরই বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় এবং ভাঙনের শিকার হয়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই সঙ্গে ঝরে যাচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময়ী শিক্ষার্থীরা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে জেলার নদীকেন্দ্রিক উপজেলা ভূঞাপুর, কালিহাতী, নাগরপুর, টাঙ্গাইল সদর এবং বন্যাকবলিত বাসাইল, মির্জাপুর, দেলদুয়ার এবং গোপালপুর উপজেলার দুই’শ বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে নাগরপুর উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ৩৪টি বিদ্যালয়ে সাড়ে ৫০ লাখ টাকা, ভূঞাপুর উপজেলায় ৩১টি বিদ্যালয়ে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, কালিহাতীতে ৪০টি বিদ্যালয়ে ২৮ লাখ টাকা,

মির্জাপুরে ৮টি বিদ্যালয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার, দেলদুয়ারে ৪৩টি বিদ্যালয়ে ২৬ লাখ ৮০ হাজার, টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ৩৭টি বিদ্যালয়ে ১৯ লাখ ৫০ হাজার, বাসাইল উপজেলায় ৬টি বিদ্যালয়ে ৫ লাখ ১৫ টাকা এবং গোপালপুর উপজেলায় একটি বিদ্যালয়ে ৩ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে ওই বছর বন্যায় দুই’শ বিদ্যালয়ে দেড় কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে দুইটি বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন নদীগর্ভে চলে গেছে। এরমধ্যে ভূঞাপুর উপজেলা নদীকেন্দ্রিক হওয়ায় এই উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে বিগত দশ বছরে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় সম্পূর্ণ যমুনা নদীর গর্ভে চলে গেছে।

ভূঞাপুর উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানায়, ভূঞাপুরে যমুনা নদীর ভাঙনে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় নদীগর্ভে চলে গেছে। ২০০০ সালে উপজেলার নিকরাইলের গোপালগঞ্জ বিদ্যালয়টি ভেঙে যাওয়ার পর গোবিন্দাসীর খানুরবাড়ি এলাকায় দ্বিতীয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। এ বছর সেই বিদ্যালয়টিও ভাঙনের কবলে রয়েছে।

এছাড়া ২০০৩ সালে চর কোনাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে যাওয়ার পর ২০০৭ সালে উপজেলার মাটিকাটা এলাকায় নির্মাণ করা হয়। পশ্চিম দোভায়া ও দোভায়া বিদ্যালয় দুইটি ২০১২ সালে ভেঙে যাওয়ায় পশ্চিম দোভায়া বিদ্যালয় মাটিকাটায় এবং দোভায়া বিদ্যালয়টি পাটিতাপাড়ায় নির্মাণ করা হয়। এতে ভাঙনে দোভায়া বিদ্যালয়টির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নদীভাঙনের কবলে পড়েছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় তা খুবই কম। এতে প্রতি বছর ভাঙনের কারণে সরকারকে বছরে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হয়।

ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের চরচন্দনী গ্রামে স্থাপিত চরচন্দনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনটি ২০২১ সালে যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। এতে ক্ষতি হয় ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টি পূর্বের স্থান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে একটি মাদরাসার একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘরে শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও সেখানে নেই তেমন শিক্ষার্থী।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারার বাসুদেবকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দুইবার স্থানান্তরের পরও এ বছর ভাঙনের কবলে রয়েছে। এছাড়া কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়া ইউনিয়নের কালিপুর দাখিল মাদরাসা ভাঙনের ফলে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তার পাশেই বেলটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির ভবন নদীগর্ভে চলে গেলেও স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিদ্যালয়ের গেটটি।

চরচন্দনী গ্রামের ৭০ বয়সী নায়েব আলী বলেন, চরচন্দনী সরকারি বিদ্যালয় যেখানে ছিল তার আশপাশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল, এখন তা নদী। চোখের সামনে নাতি-পুতিদের স্কুলটি ভেঙে গেল। যারা ওই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো তাদের অনেকেই এখন কর্মজীবনে চলে গেছে; অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

বাসুদেবকোল এলাকার আছিয়া বেওয়া বলেন, স্কুল ভেঙে গেলে নাতি-পুতিদের মন ভেঙে যায়। স্কুল ভেঙে গেলে পরবর্তীতে স্কুল দূরে চলে যায়। এতে ছাত্রছাত্রীরাও যেতে চায় না। তাছাড়া চরাঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা এমনিতেই পড়তে চায় না।

ভেঙে যাওয়া চরচন্দনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুল হাসান বলেন, বিদ্যালয় ভাঙার আগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড়শ। ভেঙে যাওয়ার বছরখানেক পর অন্যত্র শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী আসে না। কাগজ-কলমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা রয়েছে ৭০ জন। কিন্তু মাঝেমধ্যে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী আসে মাত্র।

বাসুদেবকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন, গত বছর দুইবার বিদ্যালয় স্থানান্তর করতে হয়েছে। এবছরও বিদ্যালয়টি নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এখন বিদ্যালয়টি নতুন করে কোথায় নিয়ে যাব সেটি চিন্তার বিষয়। বারবার ভাঙনের ফলে বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী তেমন নেই।

ভূঞাপুর উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মো. শরিফুল মন্ডল বলেন, চরাঞ্চলে বিদ্যালয় অবকাঠামো নির্মাণে ভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ‘চর ডিজাইন’ হিসেবে টিনের ঘর নির্মাণ (লোহার ফ্রেমে) করা হচ্ছে। নতুন করে পাকা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে না।

জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, যে এলাকাগুলোতে ভাঙনের প্রবণতা রয়েছে সেখানে চারতলা বা দুইতলা ভবন নির্মাণ না করে সহজেই স্থানান্তর করা যাবে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করলে সেটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। এক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক অপচয় হবে না। ভবন ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি শিক্ষার্থীরা ভবন পায় তাহলে তারা ঝরে পড়বে না।

জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান আলী বলেন, নদীভাঙন এলাকাগুলোতে সহজেই স্থানান্তরযোগ্য স্থাপনা যেমন টিন এঙ্গেল স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো যদি ভাঙনের মুখোমুখি হয় তাহলে এই স্থাপনাগুলো সহজেই স্থানান্তর করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এতে করে আর্থিক যে ক্ষতি হয় সেটি অনেকাংশেই পুষিয়ে নেওয়া যায়। নদীভাঙন এলাকাগুলোতে টিনশেড ভবন করা হচ্ছে। ফলে ওই চরাঞ্চল তথা নদীভাঙনপ্রবণ এলাকার শিক্ষার্থীরা উপকারভোগী হবে। এতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বা শ্রেণি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে না। শুধুমাত্র স্থানান্তরের সময়টা ব্যাঘাত হবে।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ভাঙনকবলিত বা চরাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করার আগে পরিকল্পনা ও গবেষণার প্রয়োজন।

নদীর আশপাশে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ না করাই ভালো। তিনি আরও বলেন, বিকল্প হিসেবে ভাসমান অনেক কিছুই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যে জায়গাগুলো ভাঙনপ্রবণ সেখানে স্থায়ী অবকাঠামো না করে ভাসমান যেমন স্টিমার, লঞ্চ ইত্যাদির আদলে অবকাঠামো তৈরি করা গেলে মানুষ অনেক উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান বলেন, চরাঞ্চলে বিদ্যালয় নির্মাণে জাতীয়ভাবে একটি পলিসি থাকা উচিত। চরাঞ্চল ও বন্যাপ্রবণ এলাকার বিদ্যালয়গুলো যাতে বন্যার সময়ও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেভাবেই তৈরি করা উচিত।

বিদ্যালয়গুলো উঁচুতে তৈরি করা দরকার যাতে বন্যার সময় মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। এছাড়া চরাঞ্চলে মাটির অবস্থা ভালো থাকে না। ফলে ওই বিদ্যালয়গুলোর ভিত্তিও শক্তিশালী করে করা দরকার। ভবনে যে রড ব্যবহার করা হয় বন্যার কারণে সেগুলোতে তাড়াতাড়ি মরিচা পড়ে যায়। বিল্ডিং নির্মাণে ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকশন ভালোভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *