ধনবাড়ী-জমিদার-বাড়ি

ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি: গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী!

ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধনবাড়ী ফিচার বিনোদন

সময়তরঙ্গ ডেক্স: জমিদার নেই! নেই জমিদারি শাসন ব্যবস্থাও। বদলে গেছে জমিদারি প্রথাও। কিন্তু তাদের বাড়িগুলো আজও রয়ে গেছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্মৃতির মিনার হয়ে থাকা এমনই এক ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ির একটি ধনবাড়ী। পর্যটকরা এর নির্মাণশৈলী দেখলে বুঝতে পারবেন কতটা দারুণ সুসজ্জিত জমিদার বাড়িটি। যা স্থানীয়দের কাছে নবাব প্যালেস বা নবাব মঞ্জিল নামে বেশ পরিচিত।

 

সরেজমিনে জানা যায়, জমিদার বাড়ির শতবর্ষী পুরোনো দেয়ালগুলো আমাদের ইতিহাস আর কালের সাক্ষী। ক্ষয়ে পড়া চুন-সুরকির আস্তরণগুলোয় লুকিয়ে আছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ঐতিহ্য।

 

জমিদারের বিলাসী প্রাসাদের কারুকার্যখচিত ভবনের সমারোহ। ভবনের দেয়ালের প্রতিটি পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। দেয়ালগুলো শুধুই দেয়াল নয়, যেন অক্লান্ত ইতিহাস রচয়িতার অলঙ্কার খচিত জীবন্ত ইতিহাসের বইয়ের পাতা, যেখান থেকে আমাদের নবীন চোখ হাজার বছরের ইতিহাস পড়ে নিতে পারে।

 

রাজ প্রাসাদের সামনের সুবিস্তৃত বাগানও শুধুই বাগান নয়, শত বছরে হয় তো শত হাজারবার ঝরে গেছে গোলাপের পাপড়ি, কামিনীর পাতা, তবুও আজ পাতায় পাতায় লেখা রয়ে গেছে রাজা-রাণীর রোমান্টিকতার কড়চা, পাঁপড়িগুলোয় রাজকুমারীর হাতের স্পর্শ। তাই ভ্রমণ পিয়াসী ও ইতিহাস প্রেমীরা ঐতিহ্যের খোঁজে বারবারই ছুটে চলেন এই জমিদার বাড়িতে।

 

জেলার ধনবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত জমিদার বাড়িটি যা স্থানীয়দের কাছে নবাব প্যালেস বা নবাব মঞ্জিল নামে পরিচিত। ব্রিটিশদের কাছ থেকে বাহাদুর, নওয়াব, সি.আই.ই খেতাবপ্রাপ্ত জমিদার খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ জমিদার বংশ বা জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। তাঁরই অমর কৃর্তি ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি বা নওয়াব প্যালেস।

 

এ জমিদার বাড়িটির সুদীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ধনপতি সিংহকে পরাজিত করে মোগল সেনাপতি ইস্পিঞ্জর খাঁ ও মনোয়ার খাঁ ধনবাড়ীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কয়েক পুরুষ পরের নবাব ছিলেন সৈয়দ জনাব আলী। সৈয়দ জনাব আলী ছিলেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর বাবা। তিনি তরুণ বয়সে মারা যান। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন বগুড়ার নবাব আবদুস সোবহানের মেয়ে আলতাফুন্নাহারকে; যিনি ছিলেন নিঃসন্তান।

 

তাঁর মৃত্যুর পর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সৈয়দা আখতার খাতুনকে। তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সকিনা খাতুন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নবাব ওয়াকফ নামায় তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের নাম উল্লেখ করে যান।

 

সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী পরবর্তীকালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এ জমিদারবাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারী তাঁর একমাত্র সন্তান সৈয়দা আশিকা আকবর।

 

তারপরও অনেক সময় কেটে গেছে। ধনবাড়ীর জমিদার নেই, কিন্তু চুন-সুরকির নওয়াব প্যালেস ঐশ্বর্যে ও ঐতিহ্যে ঠিকই আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। অপূর্ব স্থাপত্যকর্মের কারণে ক্রমে জমিদার বাড়িটি পরিণত হতে থাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানে। তাই নবাবের উত্তরাধিকারীরা জমিদার বাড়িতে গড়ে তোলেন পিকনিক স্পট। যা নবাব সৈয়দ হাসান আলী রয়্যাল রিসোর্ট হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। রিসোর্টটি দেখাশোনার দায়িত্বে আছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান- লাইট হাউস গ্রুপ। জেলার বংশাই ও বৈরান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এ প্রাচীন জমিদার বাড়িটি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী এবং কারুকার্যে সত্যিই মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর। তবে রিসোর্ট তৈরির পর নবাব প্যালেসে বেড়েছে চাকচিক্য এবং আধুনিকতা।

 

চার গম্বুজবিশিষ্ট অপূর্ব মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এ শতাব্দী প্রাচীন পুরো নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসটি প্রাচীরে ঘেরা। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দা সংবলিত। ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে। তোরণের দুই পাশে প্রহরীদের জন্য রয়েছে দুটি কক্ষ। তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গভর্নরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেন।

প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরো আছে ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, নায়েব ঘর, কাচারি ঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসি চত্বর। দর্শনার্থীদের জন্য প্রাসাদের ভেতরের বেশ কয়েকটি কামরা ঘুরে দেখার সুযোগ আছে। তাছাড়া বারান্দাতেও শোভা পাচ্ছে মোগল আমলের নবাবি সামগ্রী, সেগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারেন। মোগল আমলের আসবাবপত্র আপনাকে মুগ্ধ করবে।

প্যালেসটির পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার দিঘী, দিঘীর গভীরতা খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। সুন্দর ও মনোরম শান বাঁধানো ঘাঁট রয়েছে। ইচ্ছে করলে সৌখিন ভ্রমণপ্রেমীরা এখানে নৌকা ভ্রমণ ও মাছ ধরতে পারেন। সেখানে দর্শনার্থীদের ঘোরার জন্য রয়েছে দুটি সাম্পান। তা ছাড়া নবাবি স্টাইলে পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা। ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন গারোদের সংস্কৃতি ও নাচ। এ জন্য আপনাকে পূর্বেই জানিয়ে রাখতে হবে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে।

রিসোর্ট থেকে ৩০ মিনিটের দূরত্বে ঐতিহ্যবাহী মধুপুর বন। মধুপুর থেকে ৩০ মিনিটের পথ পেরুলেই রয়েছে আদিবাসী গারো পল্লী। সেখানে উপলব্ধি করা যায় গারোদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা, যা পর্যটকদের মনের খোরাক জোগাবে। রয়েছে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন-মনোমুগ্ধকর রাবার বাগান, আনারস বাগান, বাঁশ বাগান। রয়েল রিসোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপোর্ট ও গাইড দিয়ে রিসোর্টের গেস্টদের ঘুরিয়ে দেখায় আশেপাশের সব দর্শনীয় স্থান।

পর্যটকদের সুবিধার্থে নিরাপত্তারক্ষী ও ওয়েটার রয়েছে এ রিসোর্টে। এ ছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থাসহ সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এখানে। রিসোর্টটির আরেকটি বিরাট আকর্ষণ নবাব মসজিদ। রয়েল রিসোর্টের ঠিক পাশেই রয়েছে ৭০০ বছরের পুরোনো মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন এ মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। মসজিদটির পাশে একটি কক্ষ রয়েছে, যা নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার। ১৯২৯ সালে নবাবের মৃত্যুর পর থেকে এখানে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে, যা এখনো এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি। কোরআন তিলাওয়াতের হাফেজ নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁরা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন।

প্রতিদিন দেশি-বিদেশি বিপুল সংখ্যক পর্যটকের পা পড়ে এ জমিদার বাড়ির আঙিনায়। জনপদের এ ভূ-ভাগে দেখা যায়, বৈচিত্র্যের ঐক্যতান। বিশেষ করে শীত মৌসুমের পুরোটা জুড়েই ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা থাকে জমিদার বাড়িতে। শত শত পর্যটকের সরব উপস্থিতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে। তারা আসে, দেখে, জানে এবং একরাশ প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যায় আবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *