মধুপুর প্রতিনিধি: মধুপুর উপজেলায় ফ্রি ল্যান্সিংয়ের নামে নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিং ব্যবসার ভয়াল থাবা দিন দিন বাড়ছে এবং এখানে স্ক্যামারদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এসব সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।
অনলাইন ফ্রি ল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে যেমন রেমিট্যান্স আসে, তেমনি লাখো যুবকের কর্মসংস্থান হয়। তাই সরকার এ বৈধ পেশাকে নানাভাবে উৎসাহিত করে চলেছে। কিন্তু স্ক্যামিং অনলাইনে একটি প্রতারণামূলক অবৈধ ব্যবসা। টিনএজার পর্নো, অ্যাডাল্ট সাইট এবং ডেটিং সাইট নিয়ে স্ক্যামাররা কাজ করে থাকে। অন্ধকার জগতের এ ব্যবসায় যৌনতা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মধুপুর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার কিশোর ও তরুণ নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিংয়ে জড়িত। সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ডলার কামানোর ধান্ধায় এখন স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা এমনকি গৃহবধূরাও এতে যুক্ত হচ্ছেন। এই স্ক্যামিং যেমন নব্য ধনকুবের তৈরি করছে, তেমনি মাদক, জুয়াসহ নানা সামাজিক ব্যধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে আইটি বিশেষজ্ঞ তৌফিক-ই-হাসেম শরীফ জানান, স্ক্যামাররা সাধারণত আমেরিকান মডেল, পর্নোস্টার বা এসকর্টদের নগ্ন ছবি, ভিডিও বা নানা তথ্য ওয়েবসাইট থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে অ্যাডাল্ট ডেটিং সাইটে আইপি হাইড করে পোস্ট দেয়। এরপর টেক্সট নাউ নামের ভার্চুয়াল নাম্বার সার্ভিসের মাধ্যমে স্ক্যামাররা এসকর্ট সেজে হাজির হয়। যাদের এসকর্ট সার্ভিস দরকার সেই গ্রাহকরা নক করলে এসকর্ট সাজা স্ক্যামাররা ব্যক্তিগত সময় কাটানোর জন্য গ্রাহকের সঙ্গে ডলার নিয়ে দর কষাকষি শুরু করে। নগ্ন ছবি ও ভিডিও শেয়ারের পরেও অনেক গ্রাহক ভিডিও বা ভয়েস কলে রিয়েল পার্সন ভেরিফাই করতে চায়।
রোবট সফটওয়্যার দিয়ে ভয়েস বা ভিডিও কল ভেরিফিকেশনেও গ্রাহকরা সন্তুষ্ট না হলে ভাড়াটে নারীদের হাজির করে স্ক্যামাররা। এসব নারীরা স্বল্প আলোতে ন্যুড হয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে। এরপর গ্রাহকের কাছ থেকে কিছু ডলার অ্যাডভান্স নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। স্ক্যামাররা এসব ডলার রিসিভ করে বিভিন্ন ক্যাশ অ্যাপ, কার্ড বা বিট কয়েনের মাধ্যমে। এরপর বিশেষ কায়দায় ডিজিটাল পেমেন্ট সার্ভিসের অ্যাকাউন্ট খুলে ডলার বিট কয়েনে কনভার্ট করে বাংলাদেশি টাকায় রুপান্তর করে।
মধুপুরের একজন স্ক্যামার জানান, অভিজ্ঞ স্ক্যামাররা গ্রাহকদের সঙ্গে চ্যাট করে ব্যক্তিগত তথ্য, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এসএসএস উইথ সেলফি সংগ্রহের পর বিশেষ কায়দায় গ্রাহকের ক্রেডিট কার্ডের সমুদয় ডলার হাতিয়ে নেয়।
স্ক্যামার রনি সরকার জানান, ডেটিং স্ক্যাম ছাড়াও স্ক্যামাররা আমেরিকায় সম্পত্তি কেনা-বেচা, বাড়ি ভাড়া বা রিয়েল এস্টেট সাইটে গিয়ে ক্রেগলিস্ট অর্গানাইজেশনের আইপি হাইড করে লোভনীয় তথ্যে পোস্ট দেয়। আর একই কায়দায় অ্যাডভান্স ডলার নিয়ে কেটে পড়ে তারা। আমেরিকার জনপ্রিয় ক্লাসিফায়েড সাইট ব্যাকপেইজ ডটকমের আদলে মধুপুরের স্ক্যামাররা ক্লাসিফায়েড ডেটিং সাইট তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। টু ব্যাকপেইজ ডটকম, ব্যাকলিস্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং স্কিপ দ্য গেইমস ডটকম নামের সাইটগুলোর মালিক মধুপুরের কয়েকজন স্ক্যামার। এরা এখন শত কোটি টাকার মালিক।
সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন মধুপুর পৌরশহরের নয়াপাড়া ও মাস্টারপাড়া মহল্লায় অভিযান চালিয়ে পর্নো ও ডেটিং সাইট ব্যবহারের মাধ্যমে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে একজন স্ক্যামারকে ১২ লাখ টাকা আয় করার প্রমাণ পান। মধুপুর ছাড়াও ঘাটাইল, গোপালপুর, ধনবাড়ী, কালিহাতী ও ভূঞাপুরেও ছড়িয়ে পড়েছে এই স্ক্যামিং ব্যবসা।
স্থানীয়ভাবে স্ক্যামারদের বলা হয় নেট ব্যবসায়ী। মধুপুরের একটি বেসরকারি আর্কিটেক্ট কনসালটেন্টের তথ্যে দেখা যায়, দেড় বছরে মধুপুর উপজেলায় তিন শতাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে, যার প্রায় সবগুলোই স্ক্যামিং পার্টির। দুই বছর আগে যারা রিকশা চালাতেন, ইটভাটায় কাজ করতেন, তার এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন নিজেদের বহুতল ভবনে বসবাস করেন। দামি গাড়িতে চড়েন। অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শোরুম ও কারখানাও গড়ে তুলেছেন।
বি জেড এম গ্রাফিক্সের কর্ণধার প্রযুক্তিবিদ আপেল মাহমুদ জানান, স্ক্যামারদের এখনি থামাতে না পারলে ফ্রিল্যান্সিং পেশার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আস্থার সংকটে পড়ে এ শিল্প ধ্বংস হলে তখন ফরেনাররা আর কাজ দেবে না।
মধুপুরের ফ্রিল্যান্সার ও ওয়েব ডেভেলপার সবুজ মিয়া জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ফাইভার থেকে ভালো আয় করছিলেন, তারাও কু-মতলবে স্ক্যামিংয়ে চলে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
মধুপুরের নকরেক আইটির কর্ণধার সুবীর নকরেক জানান, যেখানে বৈধ ফ্রি ল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর আয় করা যায়, সেখানে স্ক্যামিংয়ের মতো প্রতারণামূলক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। এতে দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এর একটি নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে শিগগিরই।
শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী জানান, অনলাইন স্ক্যামিংয়ের টাকা এখন হাওয়ায় উড়ছে। এক শ্রেণির কিশোর ও যুবকের হাতে অঢেল অর্থ আসায় মাদক, জুয়াসহ নানা অসামাজিক কাজ বেড়ে গেছে। এর ফলে সমাজে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে।
মধুপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদ হোসেন জানান, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে পুলিশের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীমা ইয়াসমিন জানান, অবৈধ স্ক্যামিং ব্যবসার কাঁচা টাকা ভয়াবহ মাদকের প্রসার ঘটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে প্রতারণা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মধুপুরে ৬ জন স্ক্যামারকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কিছু ভবন সিলগালা এবং স্ক্যামারদের যেন বাড়ি ভাড়া না দেওয়া হয়, সে জন্য অনেক ভবন মালিককে সতর্ক করা হয়েছে।