জানা গেছে, মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল পৌর এলাকার সন্তোষে অন্তত ৩৩টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কাজগুলো শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সমন্বয় করেই। পরবর্তী সময়ে নিজ এলাকায় একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করে বঙ্গবন্ধুকে চিঠিও লিখেন তিনি। একই সঙ্গে ১৯৭৪-৭৫ সালে সন্তোষে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের ১৫ দশমিক ৩২ একর জমি লিজ নেয়ার জন্য আবেদন করেন। মৌখিক অনুমোদন পেয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন পীর শাহ্জামান মার্কেট ও ভোগ্যপণ্য সমিতিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ভাসানীর মৃত্যুর পর ১৯৮৪ সালে জাতীয় সংসদে গঠন করা হয় ‘সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড’। এ ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনের জমিটি নিয়ে ২০০৫ সালে ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর হয় মাভাবিপ্রবির।
এদিকে ২০০৫ সালেই সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্ট বোর্ডের পক্ষে সদরের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিবাদী করে ১৯৫৫-এর ৩০ ধারা রেকর্ড সংশোধনের মামলা করেন সওজ বিভাগের ফজলুল করিম। আপত্তি নং-৩১২, মৌজা সন্তোষ জেএল নং-১৯৭। ডিপি খতিয়ান ১/১ সাবেক দাগ ৮০৩ ও ৮০৪ এবং হাল দাগ ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬। দুই বছর পর ২০০৭ সালে ওই রেকর্ড মামলায় রায় পায় সওজ বিভাগ।
জানা গেছে, পীর শাহ্জামান মার্কেট ভেঙে ‘বিশ্ববিদ্যালয় পৌর সুপার মার্কেট’ নির্মাণ করতে টাঙ্গাইল পৌরসভার সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে মাভাবিপ্রবি প্রশাসন। এমনকি সরকারি সম্পত্তি লিজ না নিয়েই বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে পুরনো এক পুকুর। অথচ পরিবেশ আইন-১৯৯৫ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০-এর বিধান অনুসারে যেকোনো জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ। অভিযোগ পেয়ে এরই মধ্যে প্রশাসন বালি ভরাট বন্ধ করলেও আইন অমান্যের কাজ চলছে রাতের আঁধারে। মার্কেট নির্মাণকে কেন্দ্র করে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ। আর পুকুর ভরাট করতে চুক্তি হয়েছে কোটি টাকার।
একাধিক স্থানীয় ব্যবসায়ীর অভিযোগ, এটা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পৌরসভার জায়গা না, সওজ বিভাগ থেকে ট্রাস্টের নামে লিজ নেয়া। কোনো অনুমতি না নিয়ে এখন তারা কীভাবে মার্কেট নির্মাণ করতে পারে? এরই মধ্যে দোকান বরাদ্দের কথা বলে অনেকের কাছ থেকে ৫-১০ লাখ করে টাকাও নেয়া হয়েছে। এর আগেও ২০১৬ সালে বাজারের প্রায় দোকানির কাছ থেকেই টাকা নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বাজারে প্রায় ৩০০টি দোকানের মধ্যে ৩০টি চায়ের এবং এখানে ১০ জনের মতো আছেন প্রতিবন্ধী দোকানদার।
এরা কীভাবে এত টাকা দেবে? মূলতঃ পৌর মেয়র সিরাজুল হক আলমগীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এ কাজগুলো করছেন। এক বছর আগে তিনি কোনো কারণ ছাড়াই বাজার সমিতির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এরপর আর কোনো কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। এ বছর মেয়র মার্কেট নির্মাণ কাজে হাত দিয়েছেন, যাতে নেতৃত্বহীন বাজার সমিতি কোনো কিছু না করতে পারে।
স্থানীয়রা বলছেন, ভাসানী হুজুরের স্বপ্ন ছিল এ সন্তোষে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হবে, সেটাকে ঘিরে গড়ে উঠবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা আসবে। কিন্তু সন্তোষ বাজারকে ঘিরে এবং মওলানা ভাসানীর স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ অন্যান্য সবকিছু নিয়ে একটা চক্রান্ত চলছে বর্তমানে। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো একটি স্কুল রানীদীন মণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
পীর শাহ্জামান মার্কেট বাজার সমিতির বর্তমান আহ্বায়ক ও ভাসানীর নাতি মো. হাসরত খান ভাসানী বলেন, এ সন্তোষে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া রয়েছে। ভাসানী চেয়েছিলেন এখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যা-ই হোক, এ অঞ্চলের মানুষ ও তার ভক্তরা যাতে কিছু করে সংসার চালাতে পারেন। এজন্য তিনি ১৯৭৪-৭৫ সালে বাজারটা প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই থেকে এ অঞ্চলের মানুষ এগুলো ভোগ করে আসছে।
এখানে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যা এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সাহায্যে চলে। যেমন মাওলানা ভাসানী এতিমখানা, মুসাফিরখানা, সূচি স্কুল- এগুলো চলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের টাকায়। সেগুলো এখন ষড়যন্ত্রের মুখে পড়েছে। এ অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে আমরা বারবার প্রতিবাদও করেছি।
হাসরত খান ভাসানী বলেন, ১৯৮৪ সালে সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্ট বোর্ড গঠন করা হয়। গেজেটেও বলা আছে যে সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হবে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ১০১ একরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ৫৫ একর দেয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তারা (বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন) এখন যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। বাজারটি তো সওজের জায়গায়। তাহলে মার্কেট নির্মাণের জন্য পৌর মেয়র কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করে, এ চুক্তি সম্পূর্ণ অবৈধ। মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাতে প্রতিষ্ঠিত পীর শাহ্জামান মার্কেট ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় পৌর সুপারমার্কেট নির্মাণ আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না। সবার সঙ্গে আলোচনা করছি, এটা বন্ধ না হলে কঠোর আন্দোলনে যাব।
এ বিষয়ে মাভাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বাজারের পুরো জায়গাটা আমাদের না, মার্কেটের যে অংশ আমাদের জায়গায় পড়বে সে অংশ নিয়েই পৌরসভার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।’ জলাশয় ভরাটের প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি মেয়রকে প্রশ্ন করতে পারেন।’ পরে এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সিরাজুল হক আলমগীরকে ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ‘আপনার যদি কথা থাকে সামনে এসে বলুন প্লিজ।’ বললেও পরে তাঁর কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, আমি বিষয়টি জানি। মেয়রের সঙ্গে এরই মধ্যে কথাও বলেছি। তাকে জানিয়েছি, এটা সওজের জায়গা, এখানে কিছু করতে গেলে তাদের অনুমতি লাগবে। বর্তমানে এ কাজ বন্ধ রয়েছে।