বঙ্গবন্ধু সেতুর গাইড বাঁধে ধস, ভাঙনের আশঙ্কায় হাজারো পরিবার!

বঙ্গবন্ধু সেতুর গাইড বাঁধে ধস, ভাঙনের আশঙ্কায় হাজারো পরিবার!

ভূঞাপুর

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতুর সোয়া কিলোমিটার দক্ষিণে কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের বেলটিয়া ও হাটবাড়ী আলীপুর অংশে ৪টি লটে ভাগ করে ওই গাইড বাঁধ নির্মাণ করেছিল ৪টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সেই গাইড বাঁধের পাশে যমুনা নদীতে বড় বড় ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করার কারণে বাঁধ ভেঙে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় শত শত পরিবারের বাড়িঘর নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

২০২১ সালে ওই স্থানের ৬-৭টি বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যায়। ২০২২ সালের বর্ষায় গাইড বাঁধের মাঝখানে ২-৩ জায়গায় ডেবে যায়। চলতি মৌসুমে আবার ভাঙন আতঙ্কে এলাকাবাসী বালু উত্তোলন ও বাল্কহেড থেকে খালাস বন্ধে প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছে।

বাপাউবো সূত্রে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে (অফটেক) খনন ও ১৫৩০ মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। আর এই বাঁধটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয় ২৩৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।

স্থানীয়রা জানায়, গাইড বাঁধ নির্মাণ হওয়ায় বেলটিয়া এলাকার নদীভাঙা মানুষ ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে। দুই বছর আগে বেলটিয়ার অংশে ভাঙনের ফলে বিশালাকার পুকুর তৈরি হয়। ওই স্থানে প্রথমে জিও ব্যাগ ও সিমেণ্টের তৈরি ব্লক ফেলে ভাঙন রোধ করা হয়। পরে ভাঙনের ফলে কর্তৃপক্ষ প্রণীত নকশা পরিবর্তন করে চন্দ্রা কারে গাইড বাঁধ নির্মাণ করতে বাধ্য হয়।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড় গোলচত্বর পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোমেন লিমিটেড। ওই প্রকল্পের সড়ক প্রশস্তকরণে বালু-মাটি সরবরাহ করতে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল সাব-ঠিকাদারী নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাই আকন্দ নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অংশীদারদের মধ্যে রয়েছেন- গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম (মেম্বার), বালু ব্যবসায়ী মাসুদ রানা, ৮ নম্বর (বেলটিয়া) ইউপি সদস্য মো. শাজাহান আলী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদার, সাবেক ইউপি সদস্য সুলতান ফকির প্রমুখ। তারা যমুনা নদীর বাম তীরের বেলটিয়া অংশে বড় বড় ৫টি ড্রেজার ও ৩টি বাল্কহেড (বলগেট) এনে পাইপের ৪টি সারি প্রস্তুত করেছেন। আরও একটি প্রস্তুতের পর্যায়ে রয়েছে। ৩টি বাল্কহেডের মধ্যে একটিতে যমুনাগর্ভে ড্রেজার বসানোর জন্য স্টিলের পাইপ আনা হয়েছে। অন্যটি থেকে বালু খালাস করা হচ্ছে এবং অপরটি তীরে ভেড়ানো রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন অংশীদার জানান, গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জের তাপস ঠিকাদারের নেওয়া বালুঘাটে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে অংশীদার হন তারা। সেখান থেকে বাল্কহেডের মাধ্যমে বালু এনে বেলটিয়ায় খালাস করা হচ্ছে। ওই বালু আব্দুল মোনেম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করার কথা রয়েছে।

এদিকে আলীপুর গ্রামের প্রবাসী হাতেম আলী জানান, যমুনায় তাদের বাড়ি দুই দফায় ভেঙে গেছে। নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখ বাঁধাই করায় তিনি ও তার দুই ভাই মফিজ উদ্দিন ও হাফেজ উদ্দিন যমুনার বেলটিয়া অংশে পৈত্রিক জমিতে নতুন বাড়ি করেছেন। তিনি দুই মেয়ে-এক ছেলে ও ভাইদের নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। তিনি আরো জানান, নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ করায় এ অঞ্চলের মানুষ বসবাসের নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে সরকার বাঁধ নির্মাণ করে উপকার করেছে।

চরহামজানী গ্রামের শিক্ষক আব্দুল বাছেদ ও তার ভাই আব্দুল মালেক বেলটিয়ায় এসে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তারা জানান, নিউ ধলেশ্বরীর মুখে (অফটেক) বাঁধ নির্মাণ না হলে বেলটিয়ায় এসে বাড়ি করার কল্পনাও করা যেত না। বাঁধ নির্মাণ হওয়ায় তারা বাড়ি তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতে পারছেন। তারা আরও জানান, যমুনা ক্ষেপে গিয়ে গত বছর বাঁধে ভাঙন দেখা দেওয়ায় তারা এমনিতেই শঙ্কিত। এর মধ্যে ড্রেজার বসালে বাঁধে ভাঙন সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যমুনা নদীর বাম তীরে বেলটিয়া অংশে প্রকল্পের ১ নম্বর লটে ৪৫০ মিটার বাঁধ নির্মাণ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঢাকাস্থ এস এস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং ২ নম্বর লটে ১৭৮ মিটার টার্নিংসহ ৩২৮ মিটার বাঁধ নির্মাণ করে ঢাকাস্থ এআরকেএল ও কিউএইচএমসিএল জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি।

প্রকল্পের ১ নম্বর লটের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার গৌতম দাস ও ২ নম্বর লটের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার রুবায়েতুল ইসলাম তন্ময়সহ নদী শাসন সংশ্লিষ্ট প্রায় আধা ডজন প্রকৌশলী জানান, প্রমত্ত্বা যমুনার পেট চিরে জন্ম হওয়া নিউ ধলেশ্বরীর অফটেক বাঁধাই একটি যুগান্তকারী সাফল্য। এই সাফল্যের কৃতিত্ব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের(বাপাউবো) সঙ্গে সঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনসাধারণেরও। গাইড বাঁধের ফলে যমুনার মূলস্রোত বাম তীর ঘেষে বইছে।

তাৎক্ষণিক সামান্য লাভের জন্য ড্রেজার বসিয়ে যমুনা থেকে বালু উত্তোলন বা বাঁধের উপর চর পড়ার আগেই বালু-মাটি লোড-আনলোড করা বাঁধের জন্য হুমকি। বর্ষায় প্রমত্ত্বা যমুনা ক্ষেপে গেলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। বাঁধ ভেঙে গেলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর ও ফসলি জমিসহ সরকারের ২৩৪ কোটি টাকা নদীগর্ভে চলে যেতে পারে। এজন্য আগেই সতর্ক হওয়া জরুরি বলে তারা মতপ্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাজাহান আলী জানান, বেলটিয়ায় তার বাড়ি হওয়ায় তাকে বালু সরবরাহে কিঞ্চিৎ অংশীদার রাখা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের বালুমহাল থেকে বালু কিনে এনে মহাসড়কের মাটি ভরাট কাজে দেওয়ার কথা রয়েছে। যমুনা ক্ষেপে গেলে এমনিতেই ভাঙবে। যমুনার ভাঙন ঠেকানো সত্যিই দূরূহ বিষয়। গত বছর ড্রেজার বসানো বা বালু খালাসের কোনো বিষয় ছিল না তবুও গাইড বাঁধ ধসে গর্ত হয়েছিল। পরে তা মেরামত করা হয়েছিল। তিনি আরও জানান, গাইড বাঁধ সম্পূর্ণ বালুর উপর নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো কারণে বাঁধের নিচে গর্ত হয়ে পানি ঢুকলে পুরো বাঁধ ধ্বসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদার জানান, বেলটিয়া ও কুর্শাবেনু এলাকায় তাদের অনেক জমি-জমা আছে। জমির উপর দিয়ে পাইপ নিতে হয়। তাই তাকে কিঞ্চিৎ অংশের ভাগিদার রাখা হয়েছে। বাঁধের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজকে তিনি সমর্থন করবেন না।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, সিরাজগঞ্জ থেকে বালু এনে যমুনার বেলটিয়া অংশে আনলোড করা বা যমুনা থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে তাকে কেউ জানায়নি। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

অন্যদিকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও বালু ব্যবসায়ীদের নেতা আব্দুল হাই আকন্দ জানান, তারা সিরাজগঞ্জের ঘাট থেকে বালু কিনে বাল্কহেডের মাধ্যমে এনে বেলটিয়ায় খালাস করছেন। ড্রেজার বসিয়ে যমুনার চর থেকে বালু আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। তারা যাই করুক না কেন বাসেক ও স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করেই করবেন।

কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নাজমুল হুসেইন জানান, যমুনায় ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের কোনো তথ্য তার কাছে নেই। নিউ ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার বসানোয় পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মহাসড়ক প্রশস্তকরণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পাউবো’র উত্তোলিত বালু (ড্রেজড ম্যাটার) কিনেছে। মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণের কাজ বিশাল। তারা কোথা থেকে, কীভাবে মাটি-বালু এনে মহাসড়ক প্রশস্ত করবে- এটা উপর মহলের বিষয়, তাই তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারেন না বলে জানান তিনি।

ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. আব্দুল আওয়াল জানান, মহাসড়ক প্রশস্তকরণে মাটি ভরাটের জন্য তারা টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পাউবো কর্তৃক নিউ ধলেশ্বরীর উত্তোলিত বালু (ড্রেজড ম্যাটার) দরপত্রের মাধ্যমে কিনেছেন। এ ছাড়াও যমুনার চর থেকে বালু কেটে আনার নিমিত্তে তাদের অনুমতি রয়েছে। তবে তা বঙ্গবন্ধু সেতুর উজান ও ভাটির (কেপিআই) অঞ্চল থেকে আনা হবে কি-না তা তিনি বলতে পারেননি।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, গাইড বাঁধ ও এর আশপাশে ড্রেজিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পাউবোর কোনো ড্রেজারও ওই এলাকায় নেই। কেউ ড্রেজার বসানোর চেষ্টা বা বাঁধের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও জানান, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর সোয়া কিলোমিটার দক্ষিণে ২৩৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকায় ১৫৩০ মিটার গাইড বাঁধ (অফটেক বাঁধাই) নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণ বাঁধের সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে।

এ ছাড়াও যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে ৬ কিলোমিটার ও ভাটিতে ৬ কিলোমিটার এলাকা বাসেকের বলে জানান পাউবোর এই প্রকৌশলী। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, নির্দিষ্ট ১২ কিলোমিটার নদী বাসেকের বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিস দেখভাল করবে।

বাসেকের বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে ৬ ও ভাটিতে ৬ এই ১২ কিলোমিটার এলাকা কেপিআই হিসেবে চিহ্নিত। এই এলাকার মধ্যে ড্রেজার বসানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ ড্রেজার বসানো বা বালু উত্তোলনের চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। লোড-আনলোড করার বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে কেউ তার সাথে কোনো আলোচনা করেনি। মহাসড়কে বালু দেওয়ার জন্য লোড-আনলোড করে থাকলে বিষয়টি পাউবো বা স্থানীয় প্রশাসন দেখবে। তাছাড়া গাইড বাঁধের ক্ষতি হবে- এমন কাজ কাউকেই করতে দেওয়া হবে না।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, কোন কারণেই গাইড বাঁধের ক্ষতি এবং মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। যমুনায় ড্রেজার বাসানো ও লোড-আনলোডের বিষয়টি তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তবে বাঁধের বিষয়ে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *