নিজস্ব প্রতিবেদক: ভূঞাপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১৬টি অবৈধ বালুর ঘাট নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী। এসব বালুর ঘাট থেকে প্রতিদিন প্রায় নয় লাখ টাকা চাঁদা তুলছেন তারা। তবে এসব টাকা প্রতিমাসে সবার মধ্যে বণ্টন করা হয় বলে জানান চাঁদার টাকা আদায়ের দায়িত্বে থাকা সুরুজ্জামান মুন্সি।
অভিযোগ উঠেছে এই বিরাট আকারের চাঁদাবাজির নেপথ্যে রয়েছেন উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিএনপি নেতা মো. লিটন। তবে তারা দাবি করেন, দীর্ঘ ১৭ বছর জমির মালিকরা এখান থেকে কোনো টাকা পেতেন না। তাই এবার তারা জমির মালিকদের টাকা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এজন্য সুরুজ্জামানের মাধ্যমে প্রতিটি বালুর ঘাট থেকে টাকা তোলা হচ্ছে।
জানা যায়, বিদায়ী সরকারের সময়ে উপজেলার নিকরাইল, গোবিন্দাসি, পলশিয়াসহ আশেপাশে প্রায় ১৬টি অবৈধ বালুর ঘাট পরিচালনা করতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আর এই ঘাট পরিচালনা করতে প্রতি মাসে প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল মহলে দিতে হতো মোটা অংকের টাকা।
এসব বালু ব্যবসায়ীরা সিরাজগঞ্জ সরকারি বালু মহাল থেকে নামে মাত্র বালু কিনে এনে ভূঞাপুরের বিভিন্ন এলাকায় জমি ভাড়া নিয়ে স্তুপ করতেন। পরবর্তীতে সেই বালুর সাথে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে স্তুপকৃত বালুর সাথে মিশিয়ে বিক্রি করতেন।
সরকার পতনের পর উপজেলার সকল বালু ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপনে চলে গেলে সেই বালুর ঘাটগুলো দখলে নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। শুরু করেন আগের স্তুপকৃত বালু বিক্রি। তবে সরকার পতন হলেও বালু বিক্রির অবৈধ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। আগের মতোই প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলেও টাকা দিতে হচ্ছে তাদের। সারাদিনের খরচ বাদে যে টাকা অবশিষ্ট থাকে সেই টাকা ভাগ করে নেন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিকরাইল এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, আগে প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ ব্যবসা করতো। এখন বিএনপি নেতারা ব্যবসা করছেন, তাও আবার পুরোটা ফাওয়ের উপর। তারা জমির মালিকানা দাবি করে প্রতিদিন প্রতি বালুর ঘাটে এক থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছেন। আর এই টাকার ভাগ দেওয়া হচ্ছে প্রশাসন থেকে শুরু করে উপজেলার বিভিন্ন বিএনপি’র নেতাকর্মীদের মাঝে।
ভূঞাপুর বালুর ঘাটের কয়েকদিনের হিসাবের একটি খাতার বিবরণ থেকে দেখা যায়, সেখানে প্রতিদিনের খরচ বাদে যে টাকা থাকে সেই পুরো টাকাই নিয়ে নিচ্ছেন সুরুজ্জামান মুন্সি। এ ছাড়া হিসাবের খাতায় খরচে আরও লেখা রয়েছে প্রশাসন পাঁচ হাজার ৫০০ এবং সাংবাদিক ২ হাজার।
গত ১ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পয়েন্টে বালু বিক্রি হয়েছে নয় লাখ ৮৬ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে জমির ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ দেখানো হয়েছে নয় লাখ ১৫০ টাকা। অবশিষ্ট ৮৬ হাজার ৬৫০ টাকা সুরুজ্জামান নিয়ে গেছেন।
গত ২৭ আগস্ট একই ঘাটে বালু বিক্রি হয়েছে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা। খরচ দেখানো হয়েছে ১০ লাখ এক হাজার ৭৫ টাকা। ২০২৪ সালের জমির ভাড়া দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা। অবশিষ্ট এক লাখ ৬৩ হাজার ২২৫ টাকা সুরুজ্জামান নিয়ে গেছেন। এর আগের দিন এ ঘাটে বালু বিক্রি হয়েছে ১৫ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ টাকা। এতে খরচ দেখানো হয়েছে ১২ লাখ দুই হাজার ৪০০ টাকা। অবশিষ্ট তিন লাখ ৬৯ হাজার ১০০ টাকা নিয়ে গেছেন সুরুজ্জামান।
একই দিন পূর্ব খোলায় বালু বিক্রি হয়েছে ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা। এতে খরচ দেখানো হয়েছে আট লাখ ৪৫ হাজার ৩২৫ টাকা। অবশিষ্ট দুই লাখ ২৪ হাজার ৭৫ টাকা খাতায় স্বাক্ষর করে সুরুজ্জামান নিয়ে গেছেন। এর আগের দিন এই ঘাটে বালু বিক্রি হয়েছে ১১ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। খরচ দেখানো হয়েছে নয় লাখ ৭৪ হাজার ৫০ টাকা। অবশিষ্ট দুই লাখ ২৩ হাজার ৫০ টাকা নিয়েছেন সুরুজ্জামান।
তবে গত ২৮ আগস্ট প্রশাসনের নামে পাঁচ হাজার ৫০০ এবং গত ৩০ আগস্ট সাংবাদিকের নামে দুই হাজার টাকার হিসাব রয়েছে খরচের থাতায়।
টাকা উত্তোলনের বিষয়ে সুরুজ্জামান মুন্সি জানান, তিনি প্রতিদিন প্রতি ঘাট থেকে টাকা উত্তোলন করে নিজের কাছে জমা রাখছেন। আর এই জমাকৃত টাকা এক সময় বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন, সাইফুল ইসলাম ও লিটনের মাধ্যমে বণ্টন করা হবে।
বিএনপি নেতা মো. লিটন জানান, আগে আওয়ামী লীগ খেয়েছে এখন তারা খাচ্ছেন। এ বিষয়ে সংবাদ না করার অনুরোধ জানিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে বসে কথা বলতে চান তিনি।
নিকরাইল ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, বালুর ঘাট থেকে প্রতিদিন যে টাকা তোলা হয় তা জমির মালিকদের জমি ভাড়া বাবদ দেওয়া হবে। তবে এসবের মধ্যে তিনি জড়িত নন বলেও জানান এই নেতা।
নিকরাইল ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, দীর্ঘ ১৭ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমনে জমির মালিকরা ঠিকমত ভাড়া পাননি। এ কারণে সুরুজ্জামানের মাধ্যমে বালুর ঘাট থেকে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে প্রকৃত জমির মালিকরা যেন নায্য ভাড়া পান সে জন্য তারা এ উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এ ধরনের সংবাদ না করার জন্যও অনুরোধ করেন তিনি।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক জানান, বালু ঘাটের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।