
ঘাটাইল প্রতিনিধি : দেশের বহু স্থানে বিল-ঝিল ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলজ কালিমের সংখ্যা কমে গেলেও ঘাটাইল ও পার্শ্ববর্তী বিলেঝিলে তাদের দেখা মিলছে। দেশীয় জলচর পাখি কালিম—গাঢ় নীল, ইষৎ কালো, কড়া লাল আর হালকা সাদার মনোহর দ্যুতি ছড়িয়ে বিল-ঝিলে ঘুরে বেড়ায়। স্বভাবে ধীরস্থির হওয়ায় শিকারির হাতে এরা সহজেই প্রাণ হারায়।
জানা যায়, কালিমের ইংরেজি নাম পার্পল সোয়াম্পহেন, বৈজ্ঞানিক নাম Porphyrio porphyrio। বাংলায় ‘কাম পাখি’ ও ‘সুন্দরী পাখি’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জলাশয়ে এদের দেখা মেলে। লম্বায় ৪৫–৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। ঠোঁট ও কপাল গাঢ় লাল, মাথা থেকে গলা নীলাভ রঙে ঠাসা। পালকে বেগুনি ও নীলের মনোরম মিশেল, লেজের তলা ও গলায় সাদার ছোঁয়া। প্রশস্ত পা ও সূচালো নখ লাল ও নীল রঙের আচ্ছাদনে ঢাকা।
সকাল-সন্ধ্যায় এদের গলায় বৈচিত্র্যময় ডাক ধ্বনিত হয়— “পি-উ পি-উ, পি-ক পি-ক, পো-য়া-ক পো-য়া-ক, প-ক পক”। পুরুষের কণ্ঠস্বর ভারী, মেয়েদের কণ্ঠ মিহি। দল বেঁধে একসাথে ডাকলে বিলপাড় মুখরিত হয়ে ওঠে। কালিমরা সামাজিক পাখি, তবে আংশিক পরিযায়ী। হাওড়, বড় বিল বা জলাশয়ে নিরাপদ পরিবেশ পেলে দলবদ্ধভাবে বাস করে। এদের ডুবসাঁতারের মোহনীয় দৃশ্য সবার মন কাড়ে।
বর্ষাকাল এদের প্রজনন মৌসুম। মিলনের আগে মেয়ে পাখির মন জয়ের জন্য বেশ কসরত করে পুরুষ পাখি। ধানখেত, কচুরিপানা, ঘন জলজ উদ্ভিদ ও ঝোপঝাড়ে এরা বাসা বাঁধে। শস্যদানা, কচি ঘাসপাতা, জলজ উদ্ভিদ, নরম শাপলার পাতা ও ডগা, কেঁচো, জোঁক, শামুক, ব্যাঙ, পোকামাকড়, ছোট মাছ ও ধান বা ঘাসের বীজ—সবই এদের পছন্দের খাবার।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার চারিয়া বিল এলাকায় অনেকেই সখ করে কালিম পালন করেন। ময়মনসিংহ সদরের পরানগঞ্জে সৌখিন খামার করেছেন সাগর মিয়া। তিনি জানান, বাচ্চা কালিম ৫–৬ টাকায় বিক্রি হয়। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার লাঙ্গলজোড়া গ্রামের আব্দুস সালাম ও ঝাওয়াইল গ্রামের আব্দুল গফুরও সখ করে কালিম পোষেন। জেলার কালিহাতী, ঘাটাইল ও নাগরপুরের কয়েকটি বিলে কিছু কালিমের দেখা মেলে। চলনবিলেও এখনো কালিমের ঝাঁক দেখা যায়। অনেকেই সখ করে কালিম পোষেন। পোষ মানলে এরা উড়ে যায় না; হাস-মুরগির মতোই বাড়ির আঙিনায় ঘুরে বেড়ায়।
পাবনার সুজানগর উপজেলা সদরের দুর্গাপুরের গোলাম রসুল দীর্ঘ দিন কালিম পুষেছেন। চাকরির কারণে কয়েক মাস আগে ছেড়ে দিয়েছেন। তবু অভিজ্ঞতা থেকে জানান, গৃহপালিত কালিম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় না। পোষ মানলে খাঁচার বাইরেও বিচরণ করে। বছরে তিন চারবার এক সাথে ১২-১৫টি করে ডিম দেয়। দেখতে মুরগীর ডিমের মতো হলেও রং কিছুটা কালচে। গৃহপালিত কালিমের ডিম ভালো দামে বিক্রিও করা যায়। সপ্তাহ দুয়েক তা দিলেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। তবে জলজ বা বন্য কালিম নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশারদ আলম শাইন। তিনি গবেষণা থেকে জানান, বিলঝিলের কালিম সাধারনত ৩ থেকে ৬টি করে ডিম দেয়। তবে এখন জলাশয়ে আগের মতো প্রচুর সংখ্যায় কালিম দেখা যায় না।
অবসরপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা শামীম হাসান গবেষণা থেকে জানান, দেশের নানা প্রান্তের কিছু সৌখিন মানুষ খুঁদে খামারের আদলে কালিম পোষেণ। এটি বেআইনী। অনেক প্রতিকূল পরিবেশ পেরিয়ে বুনো কালিমরা এখনো জলাশয়ে টিকে রয়েছে। এদের টিকে থাকার শক্তিমত্তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। আই.ইউ.সি.এন কালিমকে নূন্যতম বিপদগ্রস্ত প্রাণী হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে কালিমকে সংরক্ষিত পাখি বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ঘাটাইল উপজেলার শিক্ষক এবং সৌখিন আলোকচিত্রী কামাল হোসেন দীর্ঘদিন ধরে নানা দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির পাখির ছবি তুলে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। তিনি জানান, অন্যান্য জলজ পাখির মতোই সুদৃশ্য কালিম আমাদের প্রাণ-প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। টাঙ্গাইলে বিশেষ করে ঘাটাইলের পাহাড়ি এলাকার দুই তিনটি বিলে এখনো কিছু কালিম দেখা যায়। শিকারিদের ভয়ে এরা অনেক সময় কচুরিপানার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এদেরকে ক্যামেরাবন্দী করাও কঠিন কাজ।
