দেলদুয়ারে ডাচবাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং এর গ্রাহকের টাকা নিয়ে লাপাত্তা এজেন্ট

অপরাধ অর্থনীতি দুর্নীতি দেলদুয়ার

দেলদুয়ার প্রতিনিধি: দেলদুয়ার উপজেলার তাঁতের শাড়ি খ্যাত পাথরাইল ইউনিয়নে ডাচবাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং এর নাম ব্যবহার করে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা প্রতারণা করে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ডাচ বাংলা ব্যাকের এজেন্ট হানিফ সরকার। গ্রামের সহজ সরল শত শত গ্রাহক বিশ্বাস করে এজেন্ট ব্যাংকে টাকা রেখে প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসেছেন।

প্রতারক হানিফ সরকার ব্যাংকে টাকা রেখে গ্রাহকদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন আরকেবিএসএস নামক একটি এনজিওর জমা বই। এতে করে গ্রাহকরা ব্যাংকে যে টাকা রেখেছে তার প্রমানও করতে পারছেন না। ডাচবাংলা ব্যাংকও এর দায় নিচ্ছে না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে পাথরাইলের এজেন্ট ব্যাংকিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকে ওই এজেন্টের জামানত ও কিছু কমিশন পাওনা রয়েছে। এছাড়া কোন গ্রাহকের একটি টাকাও জমা নেই।

 

জানা গেছে, ডাচ বাংলা ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ বিগত ২০১৭ সালে পাথরাইলে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করে। এজেন্ট ব্যাংকের দায়িত্ব পান টাঙ্গাইল পৌরসভার কাজিপুর এলাকার মৃত হযরত আলীর ছেলে হানিফ সরকার। এছাড়াও তিনি দেলদুয়ারের আরো কয়েকটি ডাচবাংলা এজেন্ট ব্যাংকের আউটলেট শাখায় অর্থসরবরাহের দায়িত্ব পান। বিনিময়ে তিনি পান কমিশন। কয়েক বছর ভালোই চলছিল। তার অমায়িক ব্যবহারে গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হন। এক লাখ টাকা ব্যাংকে রাখলে মাস প্রতি এক হাজার টাকা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রবাসীদের বাড়িতে টার্গেট করে তাদের প্রলুব্ধ করেন। এজেন্ট ব্যাংকে এলাকার পাঁচজনকে নিয়োগও দেন। মঙ্গলহোড় গ্রামের মুক্তা ও নয়ন নামের নামের দুইজনকে হিসাব রক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়াও হাসমত ও হালিম চৌধুরী নামের অপর দুইজকে প্রবাসীদের পরিবারের কাছ থেকে টার্গেট করে লোভ দেখিয়ে তাদেরকে প্রলুব্ধ করে টাকা আনার কাজে নিয়োগ দেন। তাদেরকে দেখে তাদের আত্বীয়স্বজন সরল বিশ্বাসে টাকা রাখেন। গ্রাহকরা এজেন্ট ব্যাংকে এসে হিসাব রক্ষক মুক্তার কাছে টাকা জমা দিয়ে যান।

গ্রাহকরা অনেকেই যারা ৫ বছর ও ১০ বছর মেয়াদী আমানত রেখেছেন তাদেরকে প্রতিমাসে কিছুদিন লাখ প্রতি এক হাজার টাকা লাভ দিয়েছেন। এছাড়া চলতি হিসাব ও সঞ্চয়ী হিসাবে যারা টাকা রেখেছেন তারা নিয়ম অনুযায়ী লেনদেন করেছেন। তাদের টাকাও ঠিকমত পরিশোধ করেছেন। গত কয়েক বছর ধরে এজেন্ট হানিফ সরকার প্রতারণার বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেন। মাস প্রতি এক হাজার টাকার লোভে পরে গ্রামের শত শত মানুষ ও প্রবাসীদের প্রায় ২০ কোটি টাকা এজেন্ট ব্যাংকে এসে হিসাব রক্ষক মুক্তা নয়নের কাছে জমা দিয়েছেন। এসব টাকা আত্মসাত করতেই প্রতারণার আশ্রয় নেন হানিফ সরকার। সে আর কে বি এস এস নামের একটি পাস বই তৈরী করে এজেন্ট ব্যাংকে জমাকৃত টাকা ওই বইয়ে লিখে দিতেন। বিপরীতে তার সরবরাহকৃত এজেন্ট ব্যাংকের সব চেক গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছেন। এজেন্ট ব্যাংকের হিসাব রক্ষক মুক্তা ও নয়ন জমাকৃত টাকার পরিমান পাস বইয়ে লিখে দিতেন।

এ বিষয়ে গ্রাহকরা প্রশ্ন করলে হানিফ সরকার উত্তর দিতেন পাস বই হলো এজেন্ট ব্যাংকে টাকা রাখার দলিল। বিগত ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে হঠাৎ করে টাকা নিয়ে হানিফ সরকার উধাও হয়ে যান। তার সব ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষও চলতি বছরের গত (১ জানুয়ারী) পাথরাইল এজেন্ট ব্যাংক শাখা বন্ধ করে অন্য শাখায় লেনদেনের জন্য সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন।

এমন ঘটনা সরেজমিনে পাথরাইল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মঙ্গলহোড়ের ইয়াসমিন আক্তারের ১৪ লাখ, আমীর হোসেনের ৫ লাখ, শিল্পি বেগমের ৭ লাখ ৫০ হাজার, আজিজুল হাকিমের ৬ লাখ, শিউলী বেগমের ৩ লাখ, আইনাল হকের ১১ লাখ, ছালমা আক্তারের ১৯ লাখ, ছবুর মিয়ার ২ লাখ, রেহেনা আক্তারের ২ লাখ ৫০ হাজার, খাদিজা আক্তারের ২ লাখ, মজিবুর রহমানের ৩ লাখ, মরিয়ম বেগমের ৫ লাখ, সুজন মিয়ার ১২ লাখ, লিপি আক্তারের ৭ লাখ, সুর্যবানুর ২ লাখ, তানিয়া আক্তারের ৬ লাখসহ অসংখ্য লোকজন এজেন্ট ব্যাংকে হানিফ সরকারের কাছে টাকা রেখে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এভাবে পাথরাইল, বোয়ালজান, মঙ্গলহোড় টুকচানপুর গ্রামের শত শত মানুষ ও প্রবাসীরা প্রায় ২০ কোটি টাকা রেখেছেন বলে জানান।

পাথরাইল বটতলার চা বিক্রেতা ভুক্তভোগী আয়নাল হক বলেন, আমরা ডাচবাংলা এজেন্ট ব্যাংকে গিয়ে হিসাবরক্ষকের কাছে টাকা জমা দিয়েছি। পরবর্তীতে জমাকৃত টাকা পাস বইয়ে লিখে দিয়েছে। পাস বইয়ের কথা বললে হানিফ বলত এজেন্ট ব্যাংকে যে টাকা রাখছেন তার প্রমান এই পাসবই। আমরা বিশ্বাস করেছি। সে পালিয়ে গেলে এখন ডাচ বাংলা ব্যাংক বলছে আপনারাতো টাকা রাখছেন এনজিওতে। ব্যাংকে রাখেন নাই। টাকা হারিয়ে আমরা পথে বসেছি। আমরা টাকা ফেরত চাই।

১৯ লাখ টাকা হারিয়ে ছালমা এখন পাগলপ্রায়। টাকা পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, আমি জমিজমা বন্ধক রেখে টাকা রেখেছি। মাসে ১৯ হাজার করে টাকা দিত। ওই টাকা দিয়ে সংসার চলত। এক বছর ধরে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে হানিফ পালিয়ে গেছে। আমার টাকার কি হবে। এই টাকা না পেলে আমি না খেয়ে মারা যাব। আপনারা আমার টাকা উঠিয়ে দেন।

ভুক্তভোগী সুজন মিয়া বলেন, আমাদের সাথে এভাবে যে প্রতারণা করবে ঘুনাক্ষরেই ভাবিনি। জমা নিয়েছে এজেন্ট ব্যাংকে। পরে জমাকৃত রশিদ নিয়ে পাসবই দিয়েছে। আমরা মনে করেছি ব্যাংকেই জমা রেখেছি। পালিয়ে যাবার পর জানতে পারি এজেন্ট ব্যাংকে কোন টাকা নাই। সব টাকা নাকি এনজিওতে রেখেছি।

এজেন্ট ব্যাংকের পাথারাইল শাখার হিসাব রক্ষক মুক্তার বলেন, হাসমত ভাইয়ের মাধ্যমে আমি নিয়োগ পাই। মালিক পালিয়ে গেলেও আমি পালাইনি। কারণ আমি কোন অপরাধ করেনি। মালিক গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। টাকা গ্রহণ করে পাস বইয়ে লিখে দিতে হয়েছে মালিককের আদেশে। তাকে আমরা জিজ্ঞাসা করেছি। যে টাকা গ্রহণ করলেন এজেন্ট ব্যাংকে লিখে দিলাম আরকেবিএসএস পাস বইয়ে। তিনি বলতেন যা বলেছি তাই করেন। এখন টাকার জন্য অনেকেই আমার বাড়িতে এসে চাপ দেন, হুমকিও দেন।

ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ টাঙ্গাইলের জোনাল ম্যানেজার মাহবুবুল আলম বলেন, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল এজেন্ট শাখার পাশাপাশি তাকে দেলদুয়ারের অন্যান্য শাখার অর্থ সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিনিময়ে তিনি কমিশন পেতেন। একটি আউটলেট শাখার অভিযোগের ভিত্তিতে তার এজেন্ট শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আমরা জানতে পারি সে অনেক মানুষের টাকা নিয়েছে। এ ঘটনায় আমরা ভুক্তভোগীদের বাড়িতে যাই। এজেন্ট ব্যাংকে টাকা রাখার প্রমাণ বা ডকুমেন্ট চাই। ভুক্তভোগীরা প্রমাণ হিসেবে আরকেবিএসএস পাস বই দেখায়। এজেন্ট হানিফ সরকারের একটি এনজিও ছিল। সব টাকা তারা এনজিওতে রেখেছে। এর দায়তো ব্যাংক নিবে না। এজেন্ট নেওয়ার সময় জামানত ও কিছু কমিশন ছাড়া হানিফ সরকারের আর কোন টাকা ডাচবাংলা ব্যাংকে জমা নেই।

এ বিষয়ে হানিফ সরকারের সাথে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর ০১৭৫৩১৪৬৩৫৪ কল দিলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *