টাঙ্গাইলের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় লাইব্রেরীতে গোপন পরীক্ষা: ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা

অপরাধ টাঙ্গাইল সদর শিক্ষা

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় লাইব্রেরীতে সাত শিক্ষার্থীর গোপনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ৫ম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে বেসরকারি লিটন একাডেমির ওই সাত শিক্ষার্থীকে সম্প্রতি ভর্তি করাসহ প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবকরা।

 

বুধবার, ৬ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টায় বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী কক্ষে সাত শিক্ষার্থী- আরাধ্যা শীল, খন্দকার আফসানা হেরা, জাকিয়া তাবাসুম বুশরা, সাবিহা বিনতে শামীম, সৈয়দ আনানূর, আয়শা সিদ্দিকা মুন, রনিত বসাক অর্পণ ও কুঞ্জ রায়-এর পরীক্ষা নেয়া হয়। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্কুলের অভিভাবকসহ সুধীজনেরা এ ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের বদলী ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সুযোগ বঞ্চিত করা সকল শিক্ষকের অন্যত্র বদলীসহ জড়িত সকলের কঠোর বিচার দাবি করেছেন তারা।

জানা যায়, ১৯৬৭ সালে টাঙ্গাইল পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের পাড়দিঘুলিয়া মৌজায় স্থাপিত মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে বিদ্যালয়টির মোট ৭৯০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বালক ৪০৬ আর বালিকা ৩৮৪জন। এছাড়া পঞ্চম শ্রেণীর ২১০জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বালক ১২৪ আর বালিকা ৮৪জন। ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত রয়েছেন তসলিমা জাহান।

 

বিষয়টি ধামাচাপা দিতে মন্ত্রণালয় নির্দেশিত ওই সাত শিক্ষার্থীর শিখন অবস্থান যাচাই করা হচ্ছিল বলে শিক্ষকরা দাবি করলেও শিক্ষার্থীদের শিখন অবস্থান যাচাই এর কোন খাতা দেখাতে পারেননি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এছাড়াও লিটন একাডেমির ৫ম শ্রেণীর উপস্থিতি খাতায় বিদ্যালয়ের গোপন ওই পরীক্ষায় অংশ নেয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে। সরকারি নিয়মানুযায়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সর্বশেষ ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভর্তির সুযোগ থাকলেও এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে সম্প্রতি ওই সাত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবকরা।

সরেজমিনে অভিভাবকদের তোলা অবৈধভাবে পরীক্ষার নেয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় চলমান ওই পরীক্ষার ভিডিও ও ছবি ধারণ করেন সংবাদের প্রতিবেদকসহ উপস্থিত সংবাদকর্মীরা। কোচিং শিক্ষার্থীদের গোপনে বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী কক্ষে পরীক্ষা নেয়ার প্রতিবাদ করায় অভিভাবক ও সংবাদকর্মীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণসহ দরজা বন্ধ করে দেন সহকারি শিক্ষক আফরোজা আক্তার ও লায়লা সিদ্দিকী। কৌশলে পরীক্ষার খাতা সরিয়ে ওই শিক্ষার্থীদের গল্পের বই পরতে দেন তারা।

গত ১৭ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে আগামী ২২ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বৃত্তি পরীক্ষায় নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের তালিকার সর্বশেষ তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে বলে জানানো হয়েছে।

ইতোমধ্যে টাউন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ একাধিক বিদ্যালয়ে বৃত্তি পরীক্ষায় নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের তালিকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হলেও প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।

প্রথম সাময়িক পরীক্ষার মূল্যায়নের ভিত্তিতে অধ্যায়নরত ৫ম শ্রেণির ৪০ভাগ বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ ২১, ২২, ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।

বৃত্তি প্রাপ্তির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কোচিং সেন্টারে অধ্যায়নরত ওই সাত শিক্ষার্থীকে গোপনে ভর্তি করানোসহ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলার লাইব্রেরী কক্ষে গোপনে মে মাসে শেষ হওয়া প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নিচ্ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তসলিমা জাহান এবং বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও সদর উপজেলা সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসাইন। এ সময় জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মোজাহারুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সহকারি শিক্ষক আফরোজা আক্তার, লায়লা সিদ্দিকী আর স্বপন কুমারকে পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

টানা পনের বছর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকার সুযোগ নিয়ে প্রতি বছরই অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে আর বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে বেসরকারি কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে মোট অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তসলিমা জাহান বলেও অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগি অভিভাবকরা। গোপনে পরীক্ষার নেয়ার বিষয়টি প্রকাশ না হলে এবারও বিদ্যালয়টিতে অধ্যায়নরত বেশ কিছু শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ বঞ্চিত হত। এখনও কেন নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের তালিকা টাঙ্গানো হয়নি এমন প্রশ্ন তোলাসহ গোপনে পরীক্ষা নেয়া কোচিং শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত শিক্ষার্থী তালিকায় তোলার শঙ্কা দেখছেন অভিভাবকরা।

অভিভাবক কানিজের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা বৃত্তির সংখ্যা বৃদ্ধির অপচেষ্টায় বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরতদের বাদ দিয়ে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। ওই সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ নানা সুবিধা ভোগ করছেন তারা। তাদের যোগসাজসে প্রতিবছরই বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা বৃত্তি দেয়ার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, বুধবার (৬ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১২টায় বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী কক্ষে কোচিংয়ের সাত শিক্ষার্থীর গোপনে মে মাসে শেষ হয়ে যাওয়া প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছিল। আমিসহ সাংবাদিকরা পরীক্ষা চলাকালীন লাইব্রেরী কক্ষে প্রবেশ করি। শিক্ষার্থী আমাদের কাছে পরীক্ষা দেয়ার কথা স্বীকার করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দায়িত্বরত সহকারি শিক্ষক আফরোজা আক্তার ও লায়লা সিদ্দিকী। তারা আমাদের সাথে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন ও লাইব্রেরী কক্ষ বন্ধ করে দেন। আমার মেয়েও পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী, তাদের এই অনৈতিক চেষ্টায় আমার মেয়েটি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে কি, এ নিয়ে চরম শঙ্কায় আছি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নষ্টকারী শিক্ষকদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।

তবে অসৌজন্যমূলক আচরণ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সহকারি শিক্ষক আফরোজা আক্তার ও লায়লা সিদ্দিকী।

লিটন একাডেমির পরিচালক লিটন রাহা বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করাই। কোন শিক্ষার্থী কোন স্কুলে ভর্তি আছে বা হবে সেটি আমার কাজ না।
বুধবার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গোপনে নেয়া পরীক্ষায় অংশ গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের নাম আপনার পঞ্চম শ্রেণীর উপস্থিতি তালিকায় কিভাবে আসলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এক নামে একাধিক জন থাকতেই পারে। মডেলের গোপন পরীক্ষার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমার একাডেমির খ্যাতি দেখে আমার বিরুদ্ধে এখন অনেকেই ষড়যন্ত্র করছেন বলেও জানান তিনি।

মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তসলিম জাহান বলেন, বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত ছাত্রীর অভিভাবক কানিজ বৃত্তি তালিকায় তার মেয়ের নাম দেয়া হবে না এমন শঙ্কা থেকে সাংবাদিকদের অভিযোগ করেছেন।

শ্রেণি কক্ষ থাকতে কেন লাইব্রেরীতে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার কারণে লাইব্রেরী কক্ষে নিয়ে ওই সাত শিক্ষার্থীর শিখন অবস্থান যাচাই এর পরীক্ষা নিচ্ছিলেন শ্রেণি শিক্ষক লায়লা। কানিজ সেটিকে ওই শিক্ষার্থীদের গোপনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে বলে প্রচার করছে। সাংবাদিকদের দেখে কেন ওই শিক্ষার্থীদের শিখন অবস্থান যাচাই পরীক্ষার খাতা সরিয়ে গল্পের বই পরতে দেয়া হয় এ প্রশ্নের কোন উত্তর এড়িয়ে যান তিনি। এছাড়াও ওই শিক্ষার্থীদের শিখন যাচাইয়ের খাতা দেখতে চাওয়া হলে সেটি দেখাতে পারেননি তিনি। এবার বিদ্যালয় থেকে ৮৫ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন বলেও জানান তিনি।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মোজাহারুল বলেন, প্রধান শিক্ষকের ফোন পেয়ে তিনি এসেছেন। পরীক্ষার বিষয়টি জানতেন না তিনি। তবে বিতর্কিত ওই সাত শিক্ষার্থীর নাম বৃত্তি তালিকায় যাবে না বলে আমাকে কথা দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক তসলিমা জাহান।

বুধবার বিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে তাকে কিছু বলা হয়নি বলে জানান সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি মো. আলমগীর হোসাইন। তাহলে কর্মস্থল ছেড়ে বিদ্যালয়ে কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষক ফোন দিয়ে বিদ্যালয়ে সাংবাদিকরা এসেছে বলে জানানোর কারণেই তার আসা। অভিযোগের বিষয় যাচাই বাছাই করার আশ্বাস দেন তিনি।

টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে গুরুত্বের সাথে বিষয়টি দেখতে বলা হবে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *