ভূঞাপুরে জলাশয় ইজারার নামে অবৈধভাবে দু’শত একর জমিতে মাছ চাষ!

অপরাধ কৃষি পরিবেশ ভূঞাপুর

ভূঞাপুর প্রতিনিধি: ভূঞাপুরে অবৈধভাবে উন্মুক্ত জলাশয় ইজারার নামে ব্যক্তি মালিকায় দুইশত একর জমিতে মাষ চাষের জন্য ফাঁদ পেতেছে কতিপয় বিএনপির নেতা-কর্মী ও তাদের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ইতোমধ্যে একটি ব্রিজের মুখে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবারগুলো চরম দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন। সম্প্রতি উপজেলার ফলদা ইউনিয়নের ফলদা এলাকার ঐতিহ্যবাহী গুজা বিল ইজারাকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটে।

 

জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী গুজা বিল জলাশয়টি বর্ষা মৌসুমে মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এ বিলকে ঘিরে কয়েকটি গ্রামের শতশত পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বিলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিনাই নদী। আর এ নদী থেকে পানি প্রবেশ ও বাহির হওয়ার কয়েকটি খাল রয়েছে। যা বর্ষা মৌসুমে পানি ঢোকে এবং বের হয়।

এদিকে স্থানীয়দের দাবি মৌসুমের শেষ ভাগে বিলের পানি বের হতে না পারলে ধান চাষ করা সম্ভব হবে না। ধান চাষ করলেও কার্প জাতীয় মাছে ধান খেয়ে ব্যাপক ক্ষতি করবে।

 

জানা যায়, এ বিলে মাত্র ২৪ একর জায়গা খাস রয়েছে। যা সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিলের চারপাশে ব্যক্তি মালিকানা নিচু জমি রয়েছে প্রায় ২০০ একর। সেখানে নিয়মিত চাষাবাদ হয়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারণে অনেক সময় ধানের চারা ডুবে যায় এবং কার্প জাতীয় মাছ ধানের চারা খেয়ে ফেলার কারণে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

স্থানীয়রা জানান, কয়েক মাস এই জলাশয়েই তাদের একমাত্র জীবিকা নির্বাহের উৎস মাছ ধরা। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, খালের মুখে বাঁধ দেয়া হয়েছে এবং বাইরের পানি প্রবেশ বা নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এতে জলাশয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং মাছের বিস্তার ব্যহত হচ্ছে।

ফলদা গ্রামের ঝনঝনিয়া এলাকার খলিলুর রহমান বলেন, এই জলাশয়ে আমরা ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে খাই। এখন যেভাবে দখল করা হচ্ছে, মনে হয় কাল থেকেই আর নামতে পারবো না। এছাড়া কিছু কার্প জাতীয় মাছ ধানের চারা খেয়ে ফেলে আমাদের ক্ষতি করে। আমরা চাই এই জলাশয় আগের মতই উন্মুক্ত থাকুক।

তিনি আরও বলেন, সবাই যেন মাছ ধরতে পারে। কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে যেন পরিণত না হয়। এই জলাশয়ের শতশত বিঘা জমি আমাদের মত গরিবদের। জমিতে আমরা মাছ ধরতে পারবো না, চাষাবাদ করতে পারবো না সেটা হবে না। আমরা স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে এর প্রতিকার চাই।

উপজেলা যুবদলের সহসভাপতি রঞ্জু মন্ডল বলেন, জলাশয় সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এর আগে এখানে বাঁধ দেয়া হয়েছিল। পরে সেই বাঁধ ভেঙে দেয়া হয়। এখন আবার বাঁধ দিয়ে এই উন্মুক্ত জলাশয় দখলের চেষ্টা করেছে একটি প্রভাবশালী মহল। এর আগে কখনো এমন হয় নাই। এর একটা প্রতিকার চাই।

ফলদা ইউনিয়নের মাইজবাড়ি গ্রামের ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি ইসহাক অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবছরই ঐ জলাশয় সরকারিভাবে ইজারা দেয়া হয়। তবে শুধু সরকারি খাস জমিটুকুই ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু ইজারাদাররা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুরো জলাশয়টা দখল করে। স্থানীয়দের বাঁধা উপেক্ষা করে খালের মুখে বাঁশের চাটাই এবং জাল দিয়ে বাঁধ দেয়।

এছাড়া তিনি স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করেন। এদের মধ্যে পৌর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজল মিঞার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গোবিন্দ মাঝি ইজারা নিয়েছে।

উপজেলা পৌর যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমিও ইজারার একজন অংশীদার। স্থানীয়রা তাদের নিজেদের স্বার্থে বাঁধ দিয়েছে।

ইজারাদার গোবিন্দ চন্দ্র রাজবংশী বলেন, ৬ বছরের জন্য ভূঞাপুর পৌর মৎসজীবী সমবায় সমিতির ২২ জন সদস্যদের নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা নিয়েছি। প্রতি বছর ৩ লাখ টাকা সরকারকে রাজস্ব দিতে হয়। খালে বাঁধ দেয়ার ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ কি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাঁধ দিয়ে মাছ ছেড়েছি। বিলের ইজারাকৃত জায়গা ২৪ একর। কিন্তু যেখানে আড়াইফুট পানি থাকবে সেখানে যেতে পারব, যতদুরই যাক। এটা বৈধতা আছে।

উপজেলা পৌরসভা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম হৃদয় এই জলাশয়ের সাথে সম্পৃক্ত আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গুজাবিল আমি পরিচালনা করি না। সেখানে আমার শেয়ারও নেই। তবে আমি যতটুকু জানি, কয়েকটি গ্রামে দু’একজন লোক নিয়ে বিল পরিচালনা করা হচ্ছে। যাদের মালিকানা জমি আছে তাদের সাথেও একটা চুক্তি করা হয়েছে।

উপজেলা মৎস কর্মকর্তা রিমা আক্তার জানান, উন্মুক্ত জলাশয় মৎসজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি জলমহাল বিধিমালা অনুযায়ী সমিতির নামে ইজারা নিয়েছেন। তা এখনো ইজারাধীন। ইজারাদার তার ইজারাকৃত জলাশয়ের মাছের নিরাপত্তার জন্য বাঁধ দিতে পারে। বর্ষাকালে যখন পানি চলে আসে তখন তো তাদের মাছ চলে যাবে। সেক্ষেত্রে তারা ক্ষতির মুখে পড়বে। ইজারাকৃত জলাশয়ের বাইরে অন্য কারো জমি বা বাঁধ দেয়ার ব্যাপারে কিছু জানেন না।

তিনি আরো জানান, যদি ঐ জলাশয়ে ব্যক্তি মালিকানা জমি থাকে তাহলে তাদেরকে জলাশয়টি যে সমিতির কাছে ইজারা দেয়া হয়েছে, সেই সমিতিকে টাকা দিয়ে তাদের সাথে শেয়ার হতে হবে। তারা যদি এটা না মানে তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু আবদুল্লাহ খান জানান, এ বিষয়ে এখনো কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *