গ্রামীণ মানুষের পুষ্টিকর সুস্বাদু জলজ খাবার মাখনা বিলুপ্তির পথে

ইতিহাস ও ঐতিহ্য কৃষি ঘাটাইল ফিচার স্বাস্থ্য

ঘাটাইল প্রতিনিধি: দেশের খাল-বিল-ঝিলে জলজ উদ্ভিদ সঠিক পরিচর্যা আর অবহেলায় এখন বৈরী পরিবেশে বিলুপ্তির পথে। নানা কারণে আজকে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ মানুষের পুষ্টিকর সুস্বাদু জলজ খাবার মাখনা।

 

টাঙ্গাইলের বিল ও নিম্নাঞ্চলে একসময় মাখনার প্রাচুর্য ছিল। বর্তমানে ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের কালিয়ান বিলে এর দেখা মেলে। বাহারি রং আর নকশাদার পুষ্টিকর মাখনা ফল এবং এর পাতা সবাইকে মুগ্ধ করে। পাতা, ফুল ও ফলের গোড়ায় থাকে অসংখ্য সুচালো কাঁটা। অসতর্ক হলেই কাঁটা বিঁধে রক্তপাতের ঝুঁকি থাকে।

মাখনার অপর নাম ফক্সনাট। ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এর আদি নিবাস। মিঠাপানির জলাধার, বিল ঝিল এবং হাওরে এর বেড়ে উঠা। মাখনাগাছ দেখতে লাল শাপলার মতোই। তবে পাতা শাপলার চেয়েও বড়।

সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে মাখনা গাছের ফুল ফলে পরিণত হয়। ফল কাঁটাযুক্ত গোটার মতো। ভেতরে থাকে অসংখ্য সাদা দানা। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, ঔষধি গুণসম্পন্ন মাখনায় প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, শর্করা, প্রোটিন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও লবণ থাকে। এটি ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণ করে। মাখনার কাঁচা বীজ ডায়রিয়ায় উপকারী। এর পাতা বাত রোগের কাজে আসে।

ফলের খোসা ছাড়িয়ে ভেতরে ছোলার দানার মতো নরম বীজ কাঁচা খাওয়া যায়। শুকিয়ে প্রসেস করে মোয়া, মুড়কি বা ডেপের খইয়ের মতো নানা সুস্বাদু খাবার তৈরি করা যায়। মাখনার দানা পিষিয়ে বানাত রুটি বানিয়ে খাওয়া যায়।

উপজেলার কালিয়ান বিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলের চতুর্দিক থেকে প্রভাবশালীরা জবরদখলে নিচ্ছে। যে যার মতো করে বিল থেকে মাটি তুলে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করছেন। প্রভাবশালীরা জমি নামে-বেনামে পত্তন নিয়ে অথবা জবরদখল করে বিল সংকুচিত করে ফেলছে। ফলে সংকুচিত হয়ে আসা বিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পুষ্টিকর মাখনা।

পাকা সড়ক থেকে নেমে কৃষিজমি পেড়িয়ে কালিয়ান বিলের মাঝখানে গিয়ে দেখা গেল কয়েক একর জায়গা জুড়ে স্বল্প পানিতে বৈচিত্র্যময় রং ছড়ানো মাখনা পাতা বাতাসে দুলছে। চারদিকে পানকৌড়ি, কালেম, ডাহুক, শামুক খোল ও বক পাখি ওড়াউড়ি করছে।

বিলের পশ্চিম পাড়ের চাম্বলতলা গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ হোসেন আলী (৭৫) জানান, বাল্যকালে কালিয়ান বিল থেকে মাখনা ফল তুলতেন। ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ মাখনা সংগ্রহ করে খাদ্যাভাব মেটাত। এটি এখনো গরিবের পুষ্টিকর ফল বলে পরিচিত।

গান্ধী গ্রামের মনোয়ারা বেগম জানান, বিল এলাকাবাসীর খাদ্য-খাবার জোগানোর অন্যতম উৎস। একসময় বিলে প্রচুর মাখনা পাওয়া যেত। মাখনার দানা পিষিয়ে বানাত রুটি। দুই-তিনটি মাখনা রুটি খেয়ে সারাদিন পাড়ি দেয়া যেত। এবারে বৃষ্টি কম হওয়ায় তেমন পানি হয়নি। ফলে মাখনা ফলের পরিমাণও কমে গেছে।

মাখনার বড় বাজার পুরান ঢাকার ইসলামপুর, বড়কাটরা ও ছোটখাটরা। কালিয়ান গ্রামের মোকছেদ আলী কালিয়ান বিলের মাখনা তুলে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন গত ৩০ বছর যাবত। তবে এবার খুব বেশি মাখনা তুলতে পারেননি জানিয়ে তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী বন উজাড় হওয়ায় এবং সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে হালচাষ করায় টিলার মাটি ধুয়ে নামছে বিলে। এছাড়া প্রভাবশালীদের জবরদখল তো আছেই। ভরাট বিলের স্বল্প পানিতে মাখনা বিস্তার লাভ করতে পারছে না। এমতাবস্থায় বিল থেকে মাখনাসহ জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব রক্ষায় সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *