টাঙ্গাইলে সুরক্ষার অভাবে এইডস রোগ ছড়াচ্ছে: বাড়ছে উদ্বেগ

অপরাধ টাঙ্গাইল সদর দুর্ঘটনা স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এইচআইভি/এইডসমুক্ত ঘোষণা করার কথা থাকলেও এর মধ্যেই টাঙ্গাইলে ঘাতক ব্যাধি এইডস নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) চারজনসহ পাঁচজনের শরীরে এইডস শনাক্ত হয়েছে। জেলায় এইডস প্রতিরোধ, প্রতিকার ও রোগ শনাক্তের ব্যবস্থা না থাকা এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারের কারণে রোগটি বিস্তার ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে জনসাধারণের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে বলে জানা গেছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাঙ্গাইল শহরের প্রাণকেন্দ্র বেবিস্ট্যান্ড এলাকার কান্দারপাড়ায় রয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো যৌনপল্লি। বর্তমানে ৩০২ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ৫৯টি বাড়িতে ছয় শতাধিক যৌনকর্মী রয়েছে। এদিকে শহরের আবাসিক হোটেল, বাসাবাড়ি ও ভাসমান সহস্রাধিক যৌনকর্মীর পাশাপাশি রয়েছে ১ হাজার ২০০ জন হিজড়া। প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার যৌনকর্মীর সঙ্গে কয়েক হাজার পুরুষ অবাধে মেলামেশা করে থাকেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ায় নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

একজন যৌনকর্মী নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘আমরা খদ্দেরের কাছে ভোগ্যপণ্য হিসেবে গণ্য হই। তাঁদের ইচ্ছামতো মনোতৃপ্তি দিতে হয় আমাদের। আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটাই রাখতে পারি, এর চেয়ে বেশি কিছু না। ফলে আমাদের জীবন সম্পূর্ণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কোনো সময় ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা অনেক বেশি। আর আমরা আক্রান্ত হলে খদ্দেরদের মধ্যেও রোগ ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক।’

এ দিকে, টাঙ্গাইলে যৌনপল্লীতে যৌনকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকি ঘাতক ব্যাধি এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে সচেতনতামূলক কোন কার্যক্রমও নেই। এইডস রোগ শনাক্তের ব্যবস্থাও নেই।

টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবজেল হক জানান, এইডস রোগীর সংখ্যা শনাক্তের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ করে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা ছাড়া বিকল্প নেই। আমাদের কার্যক্রম এইডস দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এখানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের অধীনে ড্রপ ইন সেন্টার ও লাইট হাউস এবং নারীমুক্তি সংঘ যৌনকর্মীদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে চিকিৎসাসেবা, অ্যাডভোকেসি সভা এবং নিরাপদ যৌনাচারের উপকরণ বিতরণ করে থাকেন। নারীমুক্তি সংঘ সরাসরি কান্দাপাড়া পতিতাপল্লিতে কাজ করে। এ ছাড়া লাইট হাউস আবাসিক হোটেল, বাসাবাড়ি ও ভাসমান যৌনকর্মী এবং আহছানিয়া মিশনের ড্রপ ইন সেন্টার হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে।

লাইট হাউসের সমন্বয়ক রাবিদ খান জানান, টাঙ্গাইলের আবাসিক হোটেল, বাসাবাড়ি ও ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে আবাসিক হোটেলগুলোতে চার শতাধিক, বাসাবাড়িতে প্রায় ৩০০ আর ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা তিন শতাধিক হবে। লাইট হাউসের পক্ষ থেকে অ্যাডভোকেসি সভা ও বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়ে থাকে।

আহছানিয়া মিশনের ড্রপ ইন সেন্টারের ব্যবস্থাপক মো. আবু হানিফ জানান, টাঙ্গাইলে ১ হাজার ২০০ জন হিজড়া রয়েছেন। তাঁদের জন্য চিকিৎসাসেবা, কাউন্সেলিং ও উপকরণ ড্রপ ইন সেন্টার থেকে বিতরণ করা হয়। আহছানিয়া মিশনের ড্রপ ইন সেন্টার থেকে গত আগস্ট মাসে যৌনকর্মীদের মধ্যে ২৬ হাজার ৪৭৬টি উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। ৯০ জন রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। ১২২ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এসব পরীক্ষায় কতজনের শরীরে এইডস শনাক্ত হয়েছে, সেই তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ২০০৯ সালে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয়। এ ছাড়া কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। টাঙ্গাইলে বর্তমানে চারজন হিজড়া এইডস রোগী রয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে ঘাটাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন রোগীর এইডস ধরা পড়ে। ঘাটাইলের ওই রোগী স্ত্রীর মাধ্যমে এইডসে আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। পরে তাঁদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

ঘাটাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম খোকন বলেন, ওই রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কোনো চিকিৎসাতেই তাঁর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় এইচআইভি পরীক্ষা করানো হয় ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে তাঁর এইচআইভি শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. খন্দকার সাদিকুর রহমান বলেন, আমাদের হাসপাতালে এইচআইভি/এইডস রোগ নিরূপণের ব্যবস্থা নেই। তবে শিগগিরই এইডস রোগী শনাক্তের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. মিনহাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, এইডস রোগের কোনো প্রতিষেধক বের হয়নি। তাই সচেতনতাই হলো এইডস থেকে মুক্ত থাকার অন্যতম উপায়। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা সহজ। যাঁরা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এইডস একবার হলে আর সারে না, তাই আক্রান্তের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাটা বাড়ানোর জন্য এন্টিরেক প্রো ভাইরাল থেরাপি দিতে হবে। এছাড়া, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে রোগীকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *