নিজস্ব প্রতিনিধি: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার বদল করে তারাই এখন শহরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও তদারকির দায়িত্ব পালনে স্বস্তি ফিরেছে। লাঠি হাতে বিশৃঙ্খল নগরে ট্রাফিকের শৃঙ্খলা সামলাচ্ছেন তারা। দেয়ালে দেয়ালে আন্দোলনের সময়কার নানা লেখা মুছে নতুন রঙে সাজাচ্ছেন। দেয়ালগুলোতে এখন সমাজ বদলের নানা সচেতনতার স্লোগান শোভা পাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ঝাড়ু হাতে শহরের আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। পুলিশের গুলিতে ছাত্রের শরীরের রক্তিম দেয়াল নানা আলপনায় ফুটিয়ে তুলছেন অনেকে। ছিনতাই-ডাকাতি ঠেকাতে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন অনেকে। বাজারে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট-চাঁদাবাজি রুখে দেওয়া হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমন অভাবনীয় উদ্যোগে নতুন এক শহরের দেখা পেয়েছেন বাসিন্দারা। বিভিন্ন সড়কে গত কয়েক দিনের তুলনায় যান চলাচল বেড়েছে। শহরের নিরালা মোড়, শান্তিকুঞ্জ মোড়, প্রেসক্লাব, আদালত প্রাঙ্গণসহ জনবহুল গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা সামলাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব। শিক্ষার্থীরা যা করে দেখাচ্ছে, সেটি অনুকরণীয়।
শিক্ষার্থীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে শহরের নোংরা দেয়াল ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে আঁকছেন ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন চিত্র। এসব দেয়াল চিত্র দেখলেই মনে হবে মুগ্ধ শহীদ হননি। এই বুঝি ডেকে বলবেন- ‘পানি লাগবে কারো, পানি।’ আবার ক্ষণিকের জন্য মনে হবে এখনও আবু সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়ে বলছেন- ‘চালা গুলি, গুলি কর।’ এছাড়াও হিন্দু -মুসলিম -বৌদ্ধ বন্ধনের চিত্র শোভিত হচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে।
এসব দেয়াল চিত্র দেখে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে হবে। আছে ফুল পাখি আর নানা শব্দের উচ্চারণ। অনেকদিনের জমানো কথা লিখে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও ‘এবার স্বাধীনতা রক্ষা করার পালা’, স্বাধীন বাংলার স্বাধীন গান, দিয়েছি রক্ত-দিয়েছি প্রাণ, বল বীর বল উন্নত মম শির, ৫২ তো ভুলি নাই-২৪ কে ভুলবো কেন, রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছি বিজয়- এমন নানান প্রতিবাদী উক্তি শোভা পাচ্ছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালে দেয়ালে।
অথচ কিছুদিন আগেও এসব দেয়ালে ছিল বিভিন্ন পণ্যের বাহারি বিজ্ঞাপন ও বিভিন্ন দলের পোস্টার-ফেস্টুনের পসরা। তার পরিবর্তে আজ সেখানে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের রঙ তুলির ছোঁয়ায় ফুটে তুলেছে কোটা আন্দোলনের শ্লোগানসহ দেশের বিভিন্ন চিত্র আর সমাজ সংস্কারমূলক উক্তি।
গত কয়েকদিন থেকে, ‘শিকড়’ ও কেয়ার ক্লাবসহ বিভিন্ন গ্রুপ ও নিজস্ব উদ্যোগে শহরের বিন্দুবাসিনী বালিকা বিদ্যালয় রোড, বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয়ের দেয়াল, জেলা সদর রোড, থানার দেয়ালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় শিক্ষার্থীদের এমন চিত্র আঁকতে দেখা গেছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সাইন্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী মো. জাওয়াদ সরকার বলেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতার সূর্যটাকে সমুন্নত রাখতে রাস্তাঘাটে ট্রাফিক, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং, যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিবহনের অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ডাকাত দল রুখতে এলাকাভিত্তিক নজরদারি এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেয়ালে দেয়ালে সৃজনশীলতার বিকাশ অব্যাহত রেখেছি এবং নিরলসভাবে কাজ করছি সবাই মিলে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশটা প্রকৃত পক্ষেই বৈষম্যমুক্ত হোক। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হোক। দেশে প্রকৃত পক্ষেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাক, শিক্ষিত এবং যোগ্য নেতার নেতৃত্বে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি মুক্ত একটি সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হোক। ক্ষমতার প্রতিযোগিতা না হোক, সম্পর্ক হোক সহযোগিতার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ইফফাত রাইসা নূহা বলেন, যানজটমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজ মুক্ত এবং সন্ত্রাসমুক্ত একটি সুন্দর শহর হোক। আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ে আমরা যারা একসাথে কাজ করছি তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সমস্যা শুনছি। সমাধানের চেষ্টা করছি। মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি।
দর্শনার্থীরা বলেন, দেয়ালে দেয়ালে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা কর্মীদের পোস্টার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল। এসব পোস্টার, ফেস্টুন অপসারণ করে সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়ালে দেয়ালে লিখন চলছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন উক্তি স্লোগান লিখছে, দেখতে সুন্দরই লাগছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’ বিভাগীয় সমন্বয়ক গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, টাঙ্গাইল শহর অপরিচ্ছন্ন ছিল। শিক্ষার্থীরা এই শহরের বিলবোর্ড, বিভিন্ন পোষ্টার ও আবর্জনা পরিস্কার করে একটি বাসযোগ্য শহরে পরিণত করেছেন। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে রং তুলিতে দেয়াল লিখন করছেন। সেই সঙ্গে দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন চিত্র, উক্তি, ছবি আঁকা হচ্ছে। এটি পরিবেশের জন্য এবং শহর সৌন্দর্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।