টাঙ্গাইলে পাহাড়ি টিলা কেটে সমতল ভূমি বানানো হচ্ছে!

কালিহাতী ঘাটাইল দুর্নীতি পরিবেশ মির্জাপুর সখিপুর

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের কালিহাতী, ঘাটাইল, মির্জাপুর ও সখীপুর উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ছোট-বড় অর্ধশতাধিক লালমাটির টিলা কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। এক শ্রেণির মাটি ব্যবসায়ী স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে দিন-রাত ওইসব টিলার মাটি ইটভাটায় সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাটি কাটা রোধে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হলেও স্থায়ী কোন প্রতিকার হচ্ছে না। নির্বিচারে পাহাড়ি টিলা কাটায় স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

 

 

 

বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ী ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চল; ঘাটাইল উপজেলার পূর্বাঞ্চলের দেওপাড়া, ধলাপাড়া, সাগরদীঘি, লক্ষ্মীন্দর, সন্ধানপুর, সংগ্রামপুর, রসুলপুর ও দেউলাবাড়ী ইউনিয়নের কিয়দাংশ; মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই, আজগানা, লতিফপুর, বাঁশতৈল ও তরফপুর ইউনিয়ন এবং সখীপুর উপজেলার কাকড়াজান, বহেড়াতৈল, গজারিয়া, যাদবপুর, হাতীবান্ধা, কালিয়া, দাড়িয়াপুর ও কালমেঘা ইউনিয়ন পাহাড়ি এলাকা হিসেবে পরিচিত।

উপরোক্ত চার উপজেলায় বন বিভাগের গেজেটভুক্ত বনভূমির পরিমাণ ৭৭ হাজার ৩১১ দশমিক ৭২ একর। বিএস রেকর্ড অনুযায়ী বনভূমির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৯২৩ দশমিক ১৪ একর। এরমধ্যে বিএস রেকর্ড অনুযায়ী কালিহাতী উপজেলায় ২২৪ দশমিক ৫২ একর, ঘাটাইল উপজেলায় ১৮ হাজার ৩৫৩ দশমিক ২৬ একর, মির্জাপুর উপজেলায় ৭ হাজার ৩১৮ দশমিক ৭০ একর এবং সখীপুর উপজেলায় ৩০ হাজার ২৬ দশমিক ৬৬ একর বনভূমি রয়েছে। এসব বনভূমিতে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বনায়নের গাছসহ ছোট-বড় অর্ধশতাধিক টিলা রয়েছে। ওইসব টিলায় স্থানীয় মাটিখোকোরা নানা ছলছুতো ও প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত করে এসব এলাকার পাহাড় ও টিলা কেটে ইটভাটায় মাটি বিক্রি ও সরবরাহ করছে। তাছাড়া পাহাড়ের লাল মাটি দিয়ে পুকুর ও নিচু জমি ভরাট করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফসল ও সবজি আবাদের নাম করে কিংবা বাড়িঘর নির্মাণের অজুহাতে ২০-৩০ ফুট উঁচু টিলা কেটে সমতলভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের জুগিয়াটেংগর গ্রামের আবুবকর মিয়া, আবুল হোসেন ও তার ভাই নুরুল ইসলাম প্রমুখদের নেতৃত্বে ছোট-বড় লাল মাটির অনেক পাহাড় ও টিলাসহ বন বিভাগের জমির মাটি কেটে বিক্রি করছেন। পহাড় ও টিলা কাটার আগে ওইসব স্থানের প্রাকৃতিক ও সামাজিক বনায়নের গাছগুলোও কৌশলে কেটে বিক্রি করা হয়। উল্লেখিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রতি বছর চলে লাল মাটির পাহাড় ও টিলা কাটার ধুম। এ বছরও লাল মাটির সুউচ্চ টিলা কেটে মাটি বিক্রি করে সমতলভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়কের পাশের এলাকার টিলা ইতোমধ্যে কেটে শেষ করা হয়েছে। দেওপাড়া, মলাজানি ও ঝড়কা থেকে দক্ষিণ দিকে ভানিকাত্রা হয়ে মাইধারচালা পর্যন্ত রাস্তার পাশে পাহাড় কাটা হচ্ছে অবাধে।

সখীপুর উপজেলার কাকড়াজান, বহেড়াতৈল, গজারিয়া, যাদবপুর, হাতীবান্ধা, কালিয়া, দাড়িয়াপুর ও কালমেঘা ইউনিয়নের সাপিয়ার চালা, বাগেরবাড়ি, ইন্দারজানী, গড়বাড়ি, আড়াংচালা, আমতৈল, আমগাছ চালা ও গিলাচালা প্রভৃতি এলাকায় মাটি ব্যবসায়ী শহীদ, রুস্তম আলী, হায়দর আলী, সোহেল, হাসমত ডাক্তার, পান্নু, মেহেদী, আরিফ, হাইসাব, মজনু, আজিজ ও নাফিকুল অবাধে লাল মাটির পাহাড় ও টিলা কেটে বিক্রি করছেন। মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই, আজগানা, লতিফপুর, বাঁশতৈল ও তরফপুর ইউনিয়নের পাহাড় ও টিলা কেটে বিক্রি করছেন মাটি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর দেওয়ান, আমিনুর, আবিদ শিকদার, শহিদুল দেওয়ান ও জুলহাস।

জানা গেছে, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই মাটি ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দিনে-রাতে ভেকু মেশিন দিয়ে পাহাড় ও টিলার লাল মাটি কেটে ভারি ভারি ড্রাম ট্রাকে পরিবহণ করে ইটভাটায় বিক্রি ও সরবরাহ করছেন। মাটি ভর্তি ওভারলোডের ভারি ড্রাম্প ট্রাক চলাচল করায় গ্রামীণ রাস্তা ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রামীণ রাস্তা ও আঞ্চলিক সড়কের পাশে আবাদ করা ধান ক্ষেত, সবজি ক্ষেত, বাড়িঘর, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধূলায় ঢেকে যাচ্ছে। মাটিখেকোরা পাহাড় ও টিলার মাটি কাটার আগে সেখানকার গজারি, আকাশমনি, কাঁঠাল গাছ, বাঁশঝাড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) দিয়ে যথেচ্ছভাবে পাহাড় ও টিলার মাটি কাটায় মির্জাপুরের লতিফপুর ইউনিয়নের লতিফপুর, নৌকারচালা, শেরখারচালা, ট্যাকপাড়া ও কদমা গ্রামের কয়েকটি পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি ঝুঁকিতে রয়েছে। কোন কোন স্থানে উঁচুু টিলার লাল মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহের পাশাপাশি সমতল করা জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ আবাসস্থল গড়ে তোলা হচ্ছে।

এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও মাটিখোকো চক্রের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি বিক্রি করার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। এক সময় সখীপুর উপজেলার নানা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণি বসবাস করতো। কালক্রমে জনসংখ্যার আধিক্যে বনাঞ্চল নিধন, পাহাড়-টিলা কেটে বাড়ি-ঘর ও ফ্যাক্টরী তৈরির কারণে বন্যপ্রণির মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় শুধুমাত্র ২-১টা বানর দেখা যায়- এরাও খাদ্যাভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে নির্বিচারে লাল মাটির পাহাড় ও টিলা কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করলে এবং গাছপালা ধ্বংস করলে একসময় ধরিত্রী জনমানব ও প্রাণিকূলের বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

টাঙ্গাইলের পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি বিক্রি বিরুদ্ধে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়েও মাটি ব্যবসায়ীদের ফেরানো যায়নি। বারবার দিন ও রাতে অভিযান চালিয়ে আর্থিক জরিমানা ও কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েও তেমন কোনো প্রতিকার মিলছে না। জামিনে মুক্ত হয়ে বা জরিমানা পরিশোধ করে আবার পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি বিক্রির মাধ্যমে জরিমানার টাকা উশুল করায় মেতে উঠছে। মাটি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার দলীয় স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের যোগসাজস থাকায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে স্থানীয় প্রশাসনের শক্ত অবস্থানেও পুরোপুরি সুফল মিলেনি।

কয়েকজন মাটি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে জানায়, স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, বন বিভাগের বিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতি নিয়েই তারা পাহাড় ও টিলার মাটি কাটছেন। এছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে মৌখিক সমর্থন আদায় করতে হয়। দিন শেষে তাদের হাতে দিনমজুরির টাকাই থাকে। কোনো কাজ নাই- তাই তারা মাটির ব্যবসা করে কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন।

মির্জাপুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের রহিজউদ্দিন দেওয়ানের ছেলে মাটি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর দেওয়ান দম্ভোক্তি করে জানান, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের জানিয়েই দিন-রাত মাটি কাটছেন। জাহাঙ্গীর দেওয়ান প্রকাশ্যে লতিফপুর ইউনিয়নের নৌকারচালা, শেরখারচালা ও কদমা গ্রামের লাল মাটির টিলা ভেকু মেশিন (খননযন্ত্র) দিয়ে কেটে ড্রাম ট্রাকে ইটভাটায় বিক্রি ও সরবরাহ করছেন। কয়েকটি ইট ভাটার মালিক জানায়, ইট তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে মাটি। সমতলের সাদা-কালো মাটি সহজলভ্য নয়- যা পাওয়া যায়, দাম অনেক বেশি। এদিকে, শুধু পাহাড়ি লালমাটি দিয়ে ইট তৈরি করা যায় না। লাল মাটির সঙ্গে বালু মিশিয়ে তার সঙ্গে খৈল, টিএসপি ও ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে ইট তৈরির উপযোগী করা হয়।

ঘাটাইলের লক্ষ্মীন্দর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান জানান, পাহাড়ি লাল মাটি কেটে নিয়ে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই পাহাড় কাটা শুরু হয়। প্রতিরাতেই শ’ শ’ গাড়ি মাটি নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলেও অবৈধভাবে পাহাড় ও টিলা কেটে বিক্রি করা মাটি ব্যবসায়ীদের কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। তবে তার ইউনিয়নে এখন কোনো পাহাড় কাটা হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।

মির্জাপুরের লতিফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ শিকদার জানান, লতিফপুর ইউনিয়নে টিলার লালমাটি কাটা বন্ধের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। উপজেলার অন্যান্য স্থানে অভিযান চালানো হলেও এ ইউনিয়নে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কোন অভিযান চালানো হয়নি- ফলে মাটিখেকোরা বেপরোয়া হয়ে পাহাড় ও টিলা কাটছে।

টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন জানান, পাহাড়ের লাল মাটি কাটার জন্য তারা ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মাটি কেটে যারা পরিবেশ বিনষ্ট করছে তদন্ত সাপেক্ষ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান জানান, জেলার পাহাড়ি এলাকায় বন বিভাগের জায়গা থেকে মাটি কেটে বিক্রি করায় তারা কয়েকটি ভেকু মেশিন জব্দ ও কয়েকটি মামলা দায়ের করেছেন। বিষয়টি নিয়ে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় তিনি কথা বলেছেন। এরপরও কোথাও লালমাটি বা টিলা কাটা হলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *