নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসন তামা-কাঁসা-পিতল শিল্প রক্ষায় অবশেষে উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। এ পেশা ছেড়ে চলে যাওয়া কারিগরদের আবারো কাজে ফেরানোর উদ্যোগের পাশাপাশি সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক সার্ভে করছেন। শিল্পটির ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে চলতি মাসেই জিআই পণ্যভুক্ত করার জন্য আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
শিল্পটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগররা জানান, একসময় টাঙ্গাইলের কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্রের চাহিদা ছিল সারা দেশে। কাগমারীতে তৈরি কলসের চাহিদা শুধু টাঙ্গাইলে নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এ শিল্পের সুনাম ছিল ব্যাপক। একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে তৈজসপত্র বিদেশেও রফতানি হতো। অবিভক্ত বাংলায় প্রসিদ্ধ ছিল টাঙ্গাইলের তামা, কাঁসা ও পিতল শিল্প। তবে আধুনিক ডিজাইনের মেলামাইন, প্লাস্টিক, কাচ ও স্টিলসামগ্রীর কারণে বাজার হারিয়েছে পণ্যটি। এছাড়া কাঁচামালের অভাব ও উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না শিল্পটি।
জানা যায়, মোগল শাসনামলে এ দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করতেন মোগলরা। ব্রিটিশ শাসনামলে এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহার শুরু হয়। টাঙ্গাইলের কাঁসা ও পিতলের অপূর্ব শিল্পকর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকারও এর প্রশংসা করেছে। অনেক সময় কারিগরদের বিভিন্ন পদকে ভূষিত করেছে। তাদের মধ্যে প্রয়াত মধুসূদন কর্মকার, গণেশ কর্মকার, বসন্ত কর্মকার, যোগেশ কর্মকার, হারান কর্মকার উল্লেখযোগ্য।
সরজমিনে দেখা গেছে, কাগমারীতে এখন মাত্র একটি, বাঘিলে দুটি, পোড়াবাড়িতে একটি ও মগড়ায়ে ১০-১২টি পিতল কারখানা রয়েছে। জাপান ও ইতালিসহ অন্যান্য দেশ থেকে আগে এসব তামা, কাঁসা ও পিতল আমদানি করা হতো। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, শিল্পীদের পেশা বদল ও ধাতব পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ শিল্প এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কালীপুরের পলান কর্মকার বলেন, আমি খুব কম কাজ করি। এখন আর কাজ করার সুযোগ নেই। সবকিছুর দাম অনেক আগে থেকেই বাড়ছে। যেখানে এক বস্তা কয়লার দাম ছিল ১০০ টাকা। এরপর হলো ৩০০-৪০০ টাকা। বর্তমানে এক বস্তা কয়লা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। আগে এক কেজি ভাঙা কাঁসার দাম ছিল ১৬০ টাকা। এখন তা ৪০০-৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। মানুষও এগুলো ব্যবহার করা এখন কমিয়ে দিয়েছে।
কর্মকার বাসনালয়ের মালিক প্রবীর কর্মকার বলেন, আগে কাগমারীতেই ছিল কয়েকশ পরিবার, যারা বংশানুক্রমে কাজগুলো করে আসছিল। বর্তমানে কাগমারীতে কোনো কাঁসাশিল্পী নেই বললেই চলে। আগে শহরেই ৩০-৪০টি তামা কাঁসার দোকান ছিল। এখন মাত্র তিনটি দোকান রয়েছে। আমরা ঢাকা, জামালপুর, ইসলামপুর, নবাবগঞ্জ, বিক্রমপুর ও টাঙ্গাইলের মগড়া থেকে কিছু কিছু পণ্য এনে বিক্রি করি। একেকটি পণ্য ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে তেমন একটা বেচাকেনাও নেই এখন। তিনি আরো বলেন, কয়েক দিন আগে ডিসি অফিস থেকে তিনজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। তামা, কাঁসা ও পিতলের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে চেয়েছেন তারা। শুনলাম এটি নাকি জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে।
বর্তমানে ঢাকার ধামরাই, জামালপুর, ইসলামপুর, নবাবগঞ্জ ও বিক্রমপুরের ঘোড়দৌড় বাজারে বেশকিছু কারখানা থাকলেও টাঙ্গাইলের কাগমারী, বাঘিল, পোড়াবাড়ি, মগড়া ও বল্লায় একেবারেই নেই বললেই চলে। অথচ টাঙ্গাইল পৌর এলাকার কাগমারীসহ কালিপুর, পাতুলিপাড়া, পোদ্দারপাড়া, সন্তোষ, সাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় শত শত কারিগর ছিলেন।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম বলেন, তামা-কাঁসা জিআই পণ্যভুক্ত করতে ঈদের পর আবেদন করা হবে। এরই মধ্যে টাঙ্গাইলের শাড়ি ও চমচমের স্বীকৃতি পেয়েছি। আনারস, জামুর্কীর সন্দেশের জন্য আবেদন করা হয়েছে। কালিহাতীর ইন্দুটির দই ও নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ির জন্য সার্ভে করা হচ্ছে। যে তথ্য দরকার সেগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে।