মধুপুরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ!

কৃষি দুর্নীতি ফিচার মধুপুর

মধুপুর প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের মধুপুরে কৃষিকে লাভজনক করা এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণের সরকারি উদ্যোগে কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ২১টি প্রকল্পের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মধুপুরের সদ্য বিদায়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল একাই এসব প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়ন করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠলেও এই কর্মকর্তা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

জানা গেছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি, অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন, মডেল গ্রাম, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত মানের ধান, গম ও পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ; সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণসহ ২১টি প্রকল্প চলমান মধুপুরে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য রয়েছে নির্ধারিতসংখ্যক প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, বিভিন্ন ধরনের মেশিন সরবরাহসহ নির্ধারিত প্রণোদনা।

এসব প্রকল্প অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সমন্বয়ে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। কিন্তু কৃষি অফিসের অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী জানেন না কোন প্রকল্পে বরাদ্দ কত, কটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, মাঠ দিবস হবে, কোন কোন প্রদর্শনীর পরিচর্যা ব্যয় ধরা আছে আর কোন যন্ত্র কার জন্য বরাদ্দ।

অভিযোগ রয়েছে, কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল নিজেই এসব বরাদ্দপত্র সংরক্ষণ করতেন এবং অফিস সহকারী এস এম জোবায়ের, তার ব্যক্তিগত বেতনভুক্ত বাবুল হোসেন ও নৈশপ্রহরী জিয়াউরকে সঙ্গে নিয়ে কাজগুলো সম্পাদন করেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ১০০টি হিসাবে মধুপুরে ১ হাজার ২০০টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করার কথা। এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে বলে প্রকল্প দপ্তরে তথ্য জমা হয়েছে। ওই হিসাবে মধুপুরের ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৯৬০টি পুষ্টি বাগান স্থাপন করার কথা। বাস্তবে কুড়াগাছা ও শোলাকুড়ী ইউনিয়ন বাদে অন্য কোনো ইউনিয়নেই ১০টির ওপরে প্রদর্শনী প্লট খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কৃষি কর্মকর্তা নিজেই বলেছেন, প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ২০টির মতো অর্থাৎ উপজেলায় মোট ২৪০টি পুষ্টি বাগান করা হয়েছে। তার হিসাবেই ৭২০টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়নি। প্রতিটি বাগানের বরাদ্দ ৩ হাজার ৭০০ টাকা হিসাবে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন না করেই ২৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এই প্রকল্পে কৃষক পরিবারকে দেড় শতাংশ জমিতে সারা বছর সবজি উৎপাদনের জন্য ১৭ প্রকার সবজি বীজ, ইউরিয়া, টিএসপি, জৈব সারসহ সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া আছে। কিন্তু কৃষকদের দেড় হাজার টাকার মতো পণ্য সরবরাহ করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়নের কুড়াগাছা মডেল গ্রামের আলমগীর হোসেন বলেন, কৃষি অফিস থেকে যা দিয়েছে, তা দিয়ে প্রকল্পের সব কাজ করা সম্ভব হয়নি। নিজ খরচে মডেল বাড়ি করতে হয়েছে।

মির্জাবাড়ী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণবাড়ী মডেল গ্রামের কৃষক পারুল বেগম বলেন, ‘১৮ পাতা টিন, কয়ডা খুঁটি, ১০টা স্ল্যাব, ২ কেজি কেঁচো, নেট আর কিছু সবজি বীজ দিছে। আমরা ইট, বালু ও সিমেন্ট কিনলাম। রাজমিস্ত্রির বেতন দিলাম। কৃষি অফিসারের কথা হুইনা আমগর ৭৫ হাজার টাকা খরচ অইচে। পরে আরও টেহা দিবো কইলো। আর তো কিছুই পাইলাম না।’

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাপস কুমার সরকার, মাজেদুর রহমান, মঞ্জুরুল হক, মিজানুর রহমান, আলমগীর হোসেন, শহীদুল ইসলাম জানান, কোনো প্রকল্প সম্পর্কেই তারা কিছু জানেন না। কৃষি অফিসার কৃষকদের আইডি কার্ড সংগ্রহ করে দিতে বলেন। তারা আইডি কার্ডের ফটোকপি এনে দেন। এর বাইরে তারা কিছুই জানেন না। কৃষি অফিসার ও অফিস সহকারী জোবায়ের এ বিষয়ে সব জানেন। তারাই সব করে থাকেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে সদ্য বিদায়ী কৃষি কর্মকর্তা রাসেল বলেন, আমরা যথাযথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। কোথাও কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। প্রদর্শনী প্লট কোনো ইউনিয়নে কম, কোনো ইউনিয়নে বেশি স্থাপন করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ দুলাল উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের আদেশ, নির্দেশ বা বরাদ্দপত্র- সবকিছুই প্রকল্প অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কর্মকর্তা বরাবরে পাঠানো হয়। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হলে তদন্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *