টাঙ্গাইলে জমে উঠেছে শাড়ির হাট: খরচও বেড়েছে, চাহিদাও বেড়েছে!

অর্থনীতি টাঙ্গাইল সদর দেলদুয়ার ফিচার

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লীগুলোতে আসন্ন ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নজরকাড়া বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর হাটগুলোতে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার শাড়ির চাহিদা বেশি। তবে রং, সুতা ও বিভিন্ন কাঁচামালের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাড়ির উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করেছেন তাঁতিরা।

 

 

 

 

বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ ঐতিহ্য বহন করা তাঁতের শাড়ির মধ্যে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প অনন্য। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তৈরি করছেন এ শাড়ি। তাছাড়া বিশ্ব খ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং- এর ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম, পরিচিতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে।

জানা যায়, সদর উপজেলার ধুলটিয়া, বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, বামনকুশিয়া, ঘারিন্দা, গোসাইজোয়াইর, তারটিয়া, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারী, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, ছাত্তিহাটি, আইসরা, রতনগঞ্জ কোবডোরা তাঁত বহুল গ্রাম। এ ছাড়া দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলুয়া, দেওজান, নলশোঁধা, বিষ্ণুপুর গ্রামের তাঁতপল্লীতে তৈরি হচ্ছে এ শাড়ি।

এদিকে গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলায় কিছু কিছু গ্রামে তাঁত শিল্প আছে। এ সব গ্রামের উৎপাদিত শাড়ি সদর উপজেলার বাজিতপুর ও করটিয়ার হাট থেকে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। বিশেষত দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল থেকে হাজার হাজার শাড়ি রপ্তানি হচ্ছে ভারতে।

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুদৃশ্যভাবে। পুরুষরা তাঁত বুনেন; আর চরকা কাটা ও তানা পারির কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির নারীরা। তাঁতিরা মনের রং মিশিয়ে শাড়ির জমিনে নানা ডিজাইন বা নকশা তৈরি করেন। নকশা, বুনন ও রঙের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য এনেছেন এখনকার তাঁতিরা।

দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের তাঁতি মোঃ লিয়াকত বলেন, অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে গভীর মনোযোগ দিয়ে শাড়ি তৈরি করা হয়। অন্যমনস্ক বা অদক্ষতা থাকলে শাড়ির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। ডিজাইন ভেদে একটি শাড়ি তৈরিতে ১ থেকে ২ দিন সময় লাগে। আবার প্রকারভেদে কোনো জামদানি শাড়ি তৈরিতে তিন থেকে চারদিন সময়ও লেগে যায়। ডিজাইন অনুসারে শ্রমিকরা কোনো কোনো শাড়িতে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পান বলে জানান তিনি।

সদর উপজেলার করটিয়ার হাটে তাঁত মালিক মমিনুর রহমান বলেন, রং-বেরংয়ের রেয়ন, জরি ও উন্নতমানের মোলায়েম চিকন সুতার মাধ্যমে আমরা টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করে থাকি। তবে আগের মতো শাড়ি এখন আর চলছে না। যার কারণে এ শিল্পে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করতে পারছি না। জেলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে প্রথমে ভারতীয় শাড়ি বাংলাদেশের বাজারে অবাধ প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

করটিয়ার হাটের ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো- কাপড়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকাজ। এ শাড়ি তৈরি করার জন্য আমরা ১০০, ৮০, ৮২ ও ৮৪ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করে থাকি। তবে ৮২ কাউন্টের সুতা বেশি ব্যবহার করা হয়। আর এবার ঈদ ও বৈশাখে আমাদের শাড়িগুলো ভালো বিক্রি হবে বলে প্রত্যাশা করছি।

তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসহ ভারতের নানা রাজ্যে বিশেষত পশ্চিম বাংলায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক কদর রয়েছে। অন্যান্য শাড়ি ১০ হাত থেকে সর্বোচ্চ ১১ হাত মাপে তৈরি হয়ে থাকে, আর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি হয় ১৪ হাত মাপে। এ শাড়ি নরম মোলায়েম এবং পরতে আরাম ও টেকসই। এ ছাড়া সময় ও চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ির আকর্ষণ ও নকশার ব্যঞ্জনা- বলেন তিনি।

সরজমিনে জেলা শহরের কয়েকটি বিপণি বিতান ঘুরে কয়েকজন নারী ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাম একটু বেশি হলেও অত্যাধুনিক বাহারি ডিজাইনের শাড়ি ক্রয় করতে পেরে তারা খুশি। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ডিজাইন, রং, হাতের কাজ, ও সুতার গুণাগুন ভেদে ৭০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে তাঁতের শাড়ি।

তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার এ শিল্পের উন্নয়নে কোনো নজর দিচ্ছে না। সুতার দাম দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুতার দাম ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা শাড়ির দাম বাড়াতে পারছেন না। যার ফলে এ ব্যবসা চলে গিয়েছে সাধারণ তাঁতিদের কাছ থেকে বিত্তবানদের কাছে। যার ফলে গত ১০ বছরে প্রায় ৬০ শতাংশ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। আর ঈদের পর বন্ধ হয়ে যাবে আরও অনেক তাঁত। অনেক ব্যবসায়ী এ শিল্প ছেড়ে দিয়ে কৃষিকাজ, থ্রি-পিসের ব্যবসা, প্রবাস জীবন ও গরুর খামারের কাজসহ বিভিন্ন পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন।

চাকচিক্যের আড়ালে ভারতীয় নিম্নমানের শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক আমদানি বন্ধ করতে না পারলে এ শিল্প একদিন বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করছেন এ পেশার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।

টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, করোনাভাইরাসের পর এবার টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসা একটু ভাল হবে। টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা সব সময় থাকলেও ঈদকে কেন্দ্র করে তা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক বলেন, এ বছর রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হওয়ার পর গত কয়েক বছরের তুলনায় ব্যবসায়ীদের বিক্রি অনেক ভালো হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় টাঙ্গাইল শাড়ির কদর রয়েছে। তিনি আরও বলেন, রোজার প্রথম সপ্তাহেই পাইকারি বেশির ভাগ শাড়ি বিক্রি হয়েছে। এখন টাঙ্গাইলের বিভিন্ন হাটে খুচরা শাড়ি কিনতেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতারা ভিড় করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *