সুলতান কবির: নাম আবুবক্কর সিদ্দিক ওরফে চাঁনু মিয়া। চাঁনু পাগলা নামে পরিচিত। তার বয়স (৫১)। চাঁনু মিয়া ভারসাম্যহীন একজন মানুষ। ঘুরে ঘুরে শহরের বিভিন্ন দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে ছবি আঁকতে থাকেন। আর এ ছবি আঁকা যেন তার হয়ে গেছে জীবন সঙ্গী।
বাবা মায়ের পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। ভোর হলে চাঁনু মিয়াকে আর পাওয়া যায় না তার বাড়িতে। নিজের ঘর তালা দিয়ে বের হন অজানা গন্তব্যে। যেদিকে মন চায় সেই দিকেই ছুটে বেড়ান তিনি। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেয়ালে আঁকাতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা ধরণের ছবি। তার এ নিপুণ হাতে ছোঁয়ায় তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধাদের অসাধারণ ছবি।
জানা যায়, টাঙ্গাইল পৌর শহরের এনায়েতপুর এলাকার বাসিন্দা আবুবক্কর সিদ্দিক ওরফে চাঁনু মিয়া। তিনি ছোট বেলা থেকে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাচল করতেন। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে চাঁনু মিয়া সবার ছোট। পড়াশোনা করেছেন দশম শ্রেণি পর্যন্ত। ছোট বেলায় পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সাথে মাঠে-ঘাটে কাজ করতেন। আর কাজের ফাঁকে সময় পেলে কচুরিপানা ,পোড়া মাটির টুকরো ও কয়লা দিয়ে আঁকতেন ছবি। সেখান থেকে শুরু হয় তার ছবি আঁকার যাত্রা। তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পরেন তিনি। তারপর থেকে চাঁনু মিয়া বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
তার এ ছবি দেখে মুগ্ধ সব বয়সি মানুষ। আবার সন্ধ্যা হলে চলে যান তার নিজ বাড়িতে। এভাবেই কেটে যায় তার দিন-রাত। চাঁনু মিয়া পেশায় চিত্রশিল্পী না হলেও, একজন পেশাদার চিত্রশিল্পীকে পেছনে ফেলে দিবেন তিনি। মাত্র ১০-১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফুটয়ে তুলেন সব রকমের ছবি। ছবিতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার সহধর্মিনী। আবার বিভিন্ন দেয়ালে উপদেশমূলক কথাও লেখে রেখেছেন তিনি। কিন্তু চাঁনু মিয়া ভালো করে কথা বলতে পারেন না। আবার যাও কথা বলেন তেমন বুঝা যায় না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁনু মিয়ার সঙ্গে একটি পাটের তৈরী ব্যাগ। ব্যাগের ভিতরে কয়লা ও কচুরিপানা আর কিছু কাগজের টুকরা পাশে রেখে পৌর শহরের জেলা সদর রোড, আকুরটাকুর পাড়া মোড়ে একটি দেয়ালে চাঁনু মিয়া ছবি আঁকছেন। তার এ ছবি আঁকা দেখতে ভিড় করছেন নানা বয়সি মানুষজন। তার এ ছবি দেখে সবাই প্রশংসা করছেন। জেলা সদরের মো.শাহীন চৌধুরী বলেন, আমি ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি চাঁনু মিয়া কচুরিপানা ও কয়লা দিয়ে শহরের বিভিন্ন দেয়ালে ছবি আঁকতেন। তার ছবি আঁকা খুবই সুন্দর। তার এ ছবি আঁকা দেখে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা উৎসাহিত হবেন। তাকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করলে আরও ভালো ছবি আঁকতে পারবেন।
টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর বৈল্লা এলাকার ইকবাল হোসেন আলী জানান, আমি ছোট থেকেই চানুকে চিনি। সে বিভিন্ন দেয়ালে গাছের পাতা, কয়লা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ছবি আঁকেন। তার এ ছবি আঁকা দেখে অনেক ভালো লাগে। এছাড়াও তিনি স্বাধীনতার ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকেন। তাকে যদি সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয় তাহলে তিনি আরও ভালো চিত্রশিল্পী হতে পারবেন।
এনায়েতপুর এলাকার লেবু মিয়া বলেন, আমি শহরের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে রিকশা চালাই। তখন চাঁনু পাগলাকে বিভিন্ন দেয়ালে ছবি আঁকতে দেখি। যখন যাত্রী না থাকে আমি রিকশা চালানো বন্ধ করে তার ছবি আঁকা দেখি অনেক ভালো লাগে।
চাঁনু দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকেন। যে দেয়ালে ছবি আঁকেন অনেক সময় তাকে বাসার মালিকরা গালিগালাজ করেন। তারপরও চাঁনু মিয়া থেমে যাননি। তার প্রতিভা দেখে অনেকেই মুগ্ধ। এমন ছবি তিনি কিভাবে আঁকেন চাঁনু মিয়া ভারসাম্যহীন হওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সাংস্কৃতিক কর্মী জসিমউদ্দিন বলেন, চাঁনু মিয়া অনেক সুন্দর ছবি আঁকতে পারেন। সে একজন ভারসাম্যহীন মানুষ তারপরও একজন পেশাদার চিত্রশিল্পীর মতো ছবি এঁকে থাকেন। আমি নিজেও মুগ্ধ তার এতো সুন্দর প্রতিভা দেখে। সরকারিভাবে যদি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আমার মনে হয় সে আরও ভালো ছবি আঁকতে পারবেন। তিনি টাঙ্গাইলের সুনাম অর্জন করতে পারবেন।
টাঙ্গাইল জেলা কালচারাল অফিসার মোঃ এরশাদ হাসান বলেন, আমি নিজেও দেখেছি চাঁনু মিয়া ভালো ছবি আঁকেন। কেউ যদি চাঁনু মিয়ার দায়িত্ব নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি বা জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন। আমাদের যতটুকু সুযোগ আছে অবশ্যই চেষ্টা করবো তাকে সহযোগিতা করার।