মধুপুর প্রতিনিধি: মধুপুর গড়ের লাল মাটিতে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ শুরু হয়েছে। উপজেলার মহিষমারা গ্রামের ছানোয়ার হোসেন কফি চাষের জন্য মধুপুরের মাটি, জলবায়ু বিশেষ উপযোগী হওয়ায় এ ফসলটি চাষ করে সফল হয়েছেন।
ছানোয়ার হোসেন ২০১৭ সালে শখের বশে প্রথমে রাঙামাটি জেলার রায়খালী থেকে ২০০টি চারা সংগ্রহ করে কফি আবাদ শুরু করেন। সফলতা আসায় এখন তিনি প্রায় দুই বিঘা জমিতে প্রায় ৬০০ পরিপক্ব কফির গাছ নিয়ে গড়ে তুলেছেন কফির বাগান। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় কফির ফল ঝুলতে দেখা যায়। তার এই বাগান এক খণ্ড কফির রাজ্য হয়েছে।
মধুপুরে ‘অ্যারাবিক’ ও ‘রোবাস্টা’ দুই প্রজাতির কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশি উপযোগী হওয়ায় পরীক্ষামূলক চাষে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। যে কারণে মধুপুর গড়ে আনারসের পাশাপাশি কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি গবেষকরা।
কৃষি গবেষকরা জানান, ভূ-প্রকৃতি ও কৃষিশস্যের এক বৈচিত্র্যময় অঞ্চল মধুপুর গড়। টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলার অংশ নিয়ে গঠিত এ লালমাটির গড়ে নতুন অতিথি ফসল হিসেবে কফি সুনাম কুড়াচ্ছে। মধুপুর গড় অঞ্চলের মাটি, ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতা শক্তি ভালো থাকার কারণে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
জানা যায়, লালচে হয়ে যাওয়া কফির ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করে প্রথমে পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। তারপর লম্বা সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। একটু নরম হওয়ার পর কফির ওপরের চামড়া ছাড়িয়ে নিতে হয়। রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পর কফি খোসাসহ প্রতি কেজি বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়। একটি গাছ থেকে বছরে ৫ কেজি কফি ফল পাওয়া যায়। ফলন দেওয়া শুরু করলে গাছগুলো থেকে একটানা ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত কফি পাওয়া যায়।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মধুপুরে কাজুবাদাম এবং কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫০ জন কৃষকদের মাধ্যমে ২৫ হেক্টর জমিতে কফি চাষ হয়েছে। পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে দুই রকমের কফির চাষ ব্যাপকহারে ছড়িয়েছে। এই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য এরাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফি চাষ শুরু হয়েছে।
সরেজমিন কৃষক ছানোয়ার হোসেনের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, কফির চারাগুলো দেখতে কিছুটা দেবদারু চারার মতো। গাছে গাছে লতিয়ে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ কফির ফল এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করেছে। কফির পাকা ফল টকটকে লাল, আবার কোনোটা কাঁচা হলুদের মতো।
ছানোয়ার হোসেন জানান, মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রতিটি পরিপক্ব গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল থেকে গুটি ফলে পরিণত হয়। আগস্ট মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পরিপক্বতা লাভ করলে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। বাজারজাত ও কফি পান করার জন্য উপযোগী করতে মেশিনের মাধ্যমে কফিবীজ গুঁড়া করে নিতে হয়। আবার কফির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করাও যায় বলে জানান কৃষকরা।
ফলন ভালো হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছ প্রতি বছরে পাঁচ কেজি কফি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে কফির দাম নির্ধারিত না থাকলেও তিনি গ্রিন কফি দেড় হাজার টাকা ও প্রসেসিং করা কফি আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন বলে জানান।
ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাঁচ বছরে আমার প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমি পাঁচ লাখ টাকার কফি বিক্রি করেছি। এই কফি প্রসাধনী কোম্পানি ও অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকি। একটা কফির মধ্যে ১৮ প্রকারের স্বাদ ও গন্ধ আছে। কফি প্রক্রিয়াজাত করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমি কফি প্রক্রিয়াজাত করার মেশিন কিনেছি। কফিকে বড় একটি শিল্পে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আছে আমার।’
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, মধুপুরের মাটির উর্বরতা শক্তি কফি চাষের জন্য উপযোগী। বৃষ্টিপাত, মাটির গঠন বিন্যাস মিলে গড় এলাকার লাল মাটিতে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ এলাকায় সহজে বন্যার পানি ওঠে না; তেমনি খরাও হয় না। মধুপুরে কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫০ জন কৃষকের ২৫ হেক্টর জমিতে কফি চাষ শুরু হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পর্যায়ক্রমে এ এলাকায় কফি চাষ সম্প্রসারণ ও সফলতার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন। কৃষকরা যাতে চাষে সফলতা পান, সে জন্য প্রশিক্ষণসহ প্রকল্প অনুযায়ী কৃষকদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।