সময়তরঙ্গ ডেক্স: টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে রয়েছে অপূর্ব কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া যেন সাজানো ছবির মতো। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশসহ পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এরকম পাশাপাশি চমৎকার কয়েকটি ভবন। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্য জমিদার বাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি টাঙ্গাইল সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে নাগরপুর উপজেলার লৌহজং নদীর তীরে ১৫ একর এলাকাজুড়ে অবস্থিত। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই একটি পুরনো মন্দির। জনশ্রুতি রয়েছে, শরৎকালে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা সব প্রতিমা কারিগরেরা। কালের বিবর্তনে জায়গাটা বর্তমানে নির্জন, নেই আগের সেই গৌরব আভিজাত্যের ছাপ, নেই প্রতিমা তৈরির কোনো ব্যস্ততা। মন্দির ঘুরে দেখা গেল, এর কোথাও ইট খসে পড়েছে, সেই সঙ্গে পুরনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য।
মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। জমিদার বাড়িটির সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। তবে সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে।
তারপাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তিসহ কিছু নারী মূর্তির দেখা মিলে। লতাপতায় আছন্ন ভবনটির একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেক অংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে। এই ভবনের পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা দেখা যায়। সবশেষে দ্বিতল বিশিষ্ট আরেকটি মহল যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্যসব ভবনের সাথে এই ভবনের নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
জমিদার বাড়ির পেছনে একটি দীঘি রয়েছে, আর আছে দু’টি পরিত্যক্ত কূপ। একটি প্রাচীর ঘেরা ভাঙা বড় কূপের দেখা মিলে যেখানে সেকালের জমিদার গিন্নিরা স্নান করতেন। এছাড়া, জমিদার বাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে একটি নাট মন্দির রয়েছে। এক সময় নাচে-গানে মুখর থাকত এই নাট মন্দির।
জানা যায়, ইংরেজ আমলের শেষ দিকে এবং পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতার সাথে মেইল স্টিমারসহ মালামাল এবং যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। একপর্যায়ে নাগরপুরের সাথে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণপুর থেকে প্রথমে রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল নামে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি পাকুটিয়াতে বসত স্থাপন করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঠিক শুরুতে ইংরেজদের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে তাদের জমিদারি শুরু হয়। রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডলের দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ নিঃসন্তান কিন্তু বৃন্দাবন চন্দ্রের তিন ছেলে- ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন এবং যোগেন্দ্র মোহন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারি তিনটি তরফে বিভক্ত ছিল। বৃন্দাবনের মেঝ ছেলে উপেন্দ্রকে তার কাকা নিঃসন্তান রাধা গোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র মোহন দত্তক সন্তান হিসেবে কাকার জমিদারির পুরো সম্পদের অংশ লাভ করেন। ১৯১৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে তিন ভাইয়ের নামে উদ্বোধন করা হয় একই নকশার পরপর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা। জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত।
দৃষ্টিনন্দন এ জমিদারবাড়িতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের। আজ জমিদারী নেই, আছে শুধু জমিদারের ইতিহাসের সাক্ষী। পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির পরতে পরতে রয়েছে প্রাচীন কালের নিদর্শন। জমিদার বাড়িটি সংস্কার বা জমিদারদের ইতিহাস সংরক্ষণ না হওয়াতে একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে বাড়িটি, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাবে এর ইতিহাস। এভাবেই হয়তো একদিন স্মৃতি থেকে হারিয়ে বিলুপ্তি ঘটবে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির।