সখীপুর প্রতিনিধি: সখীপুর উপজেলার কচুয়া দক্ষিণ পাড়া এলাকায় অবস্থিত চাঁদের হাট নামক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এখানে বেড়াতে আসা যুগলদের টার্গেট করে সন্ধ্যা হলেই ফেরার পথে তাঁদের আটক করে বনের ভেতর নিয়ে চক্রটি সর্বস্ব লুটে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে ।
সরেজমিনে চাঁদের হাট নামক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে নানারকম তথ্য পাওয়া যায়। গত বৃহস্পতিবার চাঁদের হাট থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে এক দম্পতিকে আটক করে ওই চক্র। পরে গজারিবনে নিয়ে গাছের সঙ্গে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন সাতজন। রাত একটার দিকে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ওই গৃহবধূ সখীপুর থানায় মামলা করেন। পুলিশ ওই রাতেই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ বর্তমানে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে।
সখীপুর থানা সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার গ্রেপ্তার হওয়া মোজাম্মেল হক (২৮) টাঙ্গাইল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অন্যদিকে, গ্রেপ্তারকৃত বুলবুল আহমেদ (২৪), লাবু মিয়া (২৬), মোহাম্মদ বাবুল (৩০), আসিফ হাসান (২৩), শফিক আহমেদকে (২৫) আদালত টাঙ্গাইল কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। আসামিদের সবার বাড়ি উপজেলার কচুয়া গ্রামের দক্ষিণ পাড়া চাঁদের হাট এলাকায়। এর মধ্যে আসিফ হাসান সরকারি মুজিব কলেজের শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলে জানা গেছে। তিনি সরকারি মুজিব কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার রকিবুল বিজয়ের অনুসারী।
এ ব্যাপারে খন্দকার রকিবুল বিজয় জানান, গ্রেপ্তার আসিফ হাসানের সরকারি মুজিব কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তার অপকর্মের কথা শুনে আমরা তাকে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ থেকে তাকে বহিষ্কার করেছি।
সরেজমিনে চাঁদের হাট-এ গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আটটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- আমাদের কলেজ, আনোয়ারা-খালেক বিদ্যাপীঠ, প্রিন্সিপাল আলীম মাহমুদ ইউনানি আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র, জ্ঞান অন্বেষা পাঠাগার, জাতীয় সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণাকেন্দ্র, হাজী নায়েব আলী দাতব্য চিকিৎসালয়, বয়স্ক শিক্ষা সচেতনতা ও বিনোদনকেন্দ্র এবং প্রচেষ্টা নামের নারী আত্মকর্মসংস্থান কেন্দ্র।
এগুলোর মধ্যে আনোয়ারা-খালেক বিদ্যাপীঠ নামের একটি কিন্ডারগার্টেনে কিছু শিক্ষার্থী থাকলেও বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো চালু হয়নি এবং সেখানে কোনো শিক্ষার্থীও নেই। তবে এখানে নানা ধরনের গাছপালা ও ফুলের বাগান থাকায় দর্শনার্থীরা ওই স্থানে বিনোদনকেন্দ্র মনে করে নিয়মিত ঘুরতে আসেন।
দেখা যায়, চাঁদের হাটের প্রধান ফটকে কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। কেন্দ্রে ঢোকার পর কিন্ডারগার্টেনের দায়িত্বে থাকা প্রধান শিক্ষক আজম মাহমুদ জানান, এটা আসলে কোনো বিনোদনকেন্দ্র নয়। এখানে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এখনো সবগুলি চালু হয়নি। কেবলমাত্র তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা বোর্ড থেকে একাদশ শ্রেণিতে এবার ভর্তির অনুমতি পেয়েছে। এ কারণেই চাঁদের হাটের ফটকে কোনো নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
চাঁদের হাটের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা আবদুল কাদের ও আনসার আলী জানান, প্রায় প্রতিদিনই অনেকেই বিকেলবেলা চাঁদের হাটে বেড়াতে আসেন। চাঁদের হাটের দুই পাশেই বনজঙ্গল। আশপাশে তেমন বসতি/ ঘরবাড়ী নেই। এখানে দর্শনার্থীদের তেমন কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।
একাধিক গ্রামবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ স্থানকে ঘিরে স্থানীয় কিছু বখাটে বেড়াতে আসা লোকজনকে, বিশেষ করে অপরিচিত যুগলকে টার্গেট করে। ওই কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার পরই তাঁদের আটক করে পাশের জঙ্গলে নিয়ে নির্যাতন করে। টাকাপয়সা, মুঠোফোন ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম ঘটায়। ইতিপূর্বে যারা ধরা পড়েছেন, তারা সবাই সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় ছিঁচকে সন্ত্রাসী। তাদের কেউ কেউবা মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত, নেশাগ্রস্ত সন্ত্রাসী চক্র বলে জানা গেছে।
‘চাঁদের হাট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সরকারি সা’দত কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য প্রফেসর আলীম মাহমুদ বলেন, ‘চাঁদের হাট আসলে কোনো বিনোদনকেন্দ্র নয়। এখানে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে আমাদের অনুমতি নিয়ে কেউ কেউ মাঝে-মধ্যে বেড়াতে আসেন। বৃহস্পতিবার রাতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা ঘটেছে চাঁদের হাটের বাইরে।’
মামলার বিবরণে ধর্ষিতার বক্তব্য থেকে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বিকেলবেলা তাঁরা চাঁদের হাটে বেড়াতে যায়। সন্ধ্যার একটু আগে বুলবুল ও বাবুল নামের দুই যুবক তাদের আটক করে। তারা বারবার স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিলেও সন্ত্রাসীরা তা না মেনে তার স্বামীর মানিব্যাগ ও তাদের মুঠোফোন কেড়ে নেয় এবং একপর্যায়ে তাদের মারধর করা হয় ।
এরপর শফিক নামের একটি ছেলেকে ফোনে ডাকে। শফিক কয়েকজন বন্ধুসহ হাতে লাঠি নিয়ে এসে তার স্বামীকে পেটায়। পরে কয়েকজন তার স্বামীকে ধরে রাখে ও তাকে কয়েকজন টেনে-হিঁচড়ে পাশের গজারি বনে নিয়ে গিয়ে দলবদ্ধভাবে পাঁচজন ধর্ষণ করে। এরপর তার হুঁশ ছিল না। তবে তারা সংখ্যায় সাতজনের বেশি ছিল বলে ধর্ষিতা নারী জানায়। ধর্ষণের আগে তারা বলেছে, ‘চাঁদের হাটে বেড়াতে আসা যুগলদের আটক করে এ ধরনের কাজ তারা এর আগেও অনেক করেছে।’
সখীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, আসামিদের একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত বাকি পাঁচ আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আসামিরা এলাকায় নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে তিনি জানান।