টাঙ্গাইলে গ্রীণ অয়েল তৈরির কারখানা চলছে পরিবেশের ছাড়পত্রহীন

টাঙ্গাইলে গ্রীণ অয়েল তৈরির কারখানা চলছে পরিবেশের ছাড়পত্রহীন

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর পরিবেশ ফিচার

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের বররিয়া এলাকায় নির্মিত হয়েছে মা বাবার দোয়া গ্রীণ অয়েল কারখানাটি পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ব্যতিত আবাসিক এলাকায় চলছে। গ্রীণ অয়েল তৈরির মারাত্মক ধোঁয়ায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন এলাকাবাসী। দাহ্য ওই পদার্থ তৈরিতে কাঠ পোড়ানোসহ কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তায় কোন পোশাক ব্যবহার না করায় চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন শ্রমিকরা। শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতাসহ ধোঁয়ার দূর্গন্ধে নানা ধরণের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলেও জানান স্থানীয়রা। দ্রুত কারখানাটি বন্ধ অথবা অন্যত্র সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।

 

স্থানীয়রা জানায়, সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের বররিয়ার শলী মন্ডল ও লিটন নামের দুই ব্যক্তির মালিকাধীন প্রায় ২০ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়ে উপজেলার গালা ইউনিয়নের বার্থা গ্রামের আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যবসায়ি মা বাবার দোয়া গ্রীণ অয়েল কারখানাটি নির্মাণ করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চলছে ওই কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম।

 

সরেজমিন দেখা গেছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বররিয়া গ্রামে দিনরাত কারখানাটি চলছে। নির্মিত গ্রীণ অয়েল কারখানার গেইটে নেই কোন সাইন বোর্ড। কারখানায় কর্মরত ৯ জন শ্রমিক দিনরাত গ্রীণ অয়েল উৎপাদনের কাজ করছেন। ওই গ্রীণ অয়েল তৈরিতে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বনের কাঠ। দাহ্য ওই পদার্থ উৎপাদনে সম্পৃক্ত শ্রমিকরাও নিরাপত্তায় ব্যবহার করছেন না বিশেষ কোন পোশাক। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের নেই স্বাস্থ্য সনদ।

 

কারখানায় কর্মকর্তারা জানায়, ক্রুট ও স্লাইস (ডিজেলের গাদ) পরিশোধন করে তৈরি করা হচ্ছে ওই গ্রীণ অয়েল। পাকা সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে উৎপাদিত ওই গ্রীণ অয়েল। ৪০/৪৫ টাকা দরে এর প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহে প্রায় ৪/৫ হাজার লিটার গ্রীণ অয়েল উৎপাদন হয় বলেও জানান তারা।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, নীতিমালা অমান্য করে এই আবাসিক এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে কারখানাটি। কারখানার নির্গত ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ নষ্ট হওয়াসহ মারাত্মকভাবে বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। জনবসতিহীন এলাকায় এ ধরণের কারখানা তৈরির বিধান থাকলেও আবাসিক এলাকার কারখানাটি পেল বিভিন্ন দফতরের সনদ? কারখানাটির সনদ প্রাপ্তিতে সনদদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কারখানা তৈরির স্থান পরিদর্শন করেছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। দ্রুত কারখানাটি বন্ধ অথবা অন্যত্র সড়িয়ে নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

বররিয়া গ্রামের বাসিন্দা রহিজ উদ্দিন বলেন, তেল বিক্রি করার কথা বলে জমিটি ভাড়া নিয়েছিল বার্থা গ্রামের আনোয়ার। এখন এখানেই তেল উৎপাদন শুরু করেছে। কারখানায় উৎপাদিত তেলের গন্ধে এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পরেছে। এতে চরম কষ্ট ভোগ করছে এলাকাবাসি। আবাসিক এলাকায় কারখানাটি নির্মাণ করা ঠিক হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি।

স্থানীয় বাবুল মিয়া বলেন, বার্থা গ্রামের আনোয়ার কারখানাটি নির্মাণ করেছেন। স্থানীয়দের কাছে গোপন রেখে কারখানাটি নির্মাণ করা হয়েছে। গাদ পুড়িয়ে তেল বানানো হচ্ছে কারখানাটিতে। গাদ পোড়ানোর পঁচা গন্ধে এলাকায় থাকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে বলে জানান তিনি।

সাবেক ইউপি সদস্য ও বররিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য সৈয়দ শাহীন বলেন, কারখানাটি নির্মাণের বিষয়ে আমরা অবগত ছিলাম না। কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার গন্ধে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পরেছে। চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা স্থানীয়রা কারখানার দূর্গন্ধে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না। শিশু, মহিলাসহ বৃদ্ধরা রয়েছেন হাঁপানীর মত স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। কারখানাটির বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর এলাকার সকল মানুষ মিলে একটি দরখাস্ত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

জমির মালিক শলী মন্ডল বলেন, আমার জমিটি পাঁচ বছরের নামে ভাড়া নিয়েছে বার্থা গ্রামের আনোয়ার। এখানে কিসের কারখানা নির্মাণ করা হবে সেটিও তাকে জানানো হয়নি। তবে ভাড়া দেয়ার চুক্তিনামা দলিলে পরিবেশ নষ্টের মত কিছু অথবা অবৈধ কিছু নির্মাণ করা হলে, জমির মালিক যে কোন সময় চুক্তি বাতিল করতে পারবে বলে উল্লেখ করা আছে।

কারখানায় অপারেটর পদে কর্মরত আখতার হোসেন বলেন, জ্বালানী তেল তৈরি করা হচ্ছে কারখানায়। এটি মূলতঃ পরিশোধন কারখানা। বিশেষ পোশাক বা স্বাস্থ্য সনদ আছে কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে, আছে বলে বক্তব্য শেষ করেন তিনি।

কারখানার ম্যানেজার আনিস বলেন, ডিজেলের গাদ (ক্রুট ও স্লাইস) চট্টগ্রাম থেকে এনে এই কারখানায় পরিশোধন করে গ্রীণ অয়েল তৈরি করা হচ্ছে। এই অয়েল সড়ক নির্মাণে কার্পেটিং এর কাজে ব্যবহার করা হয়। পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য টাকা জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া কারখানা পরিচালনার শিল্প সনদ, ভ্যাট লাইসেন্স, কলকারখানা সনদ, ফায়ার লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ জেলা প্রশাসকের এনওসি নেয়া হয়েছে। কারখানার নির্গত ধোঁয়ায় দুর্গন্ধ নিরসনে ইন্ডিয়া থেকে একটি কেমিক্যাল আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

মা বাবার দোয়া গ্রীণ অয়েল কারখানার মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, আপনি কি সরকারি লোক, তাহলে কেন আপনাকে কারখানার কাগজপত্র দেখাতে হবে।

বররিয়ার ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম রতন বলেন, কারখানার দূর্গন্ধে বসবাস করার অযোগ্য হয়ে উঠেছে এই এলাকা। এলাকাবাসীকে নিয়ে দ্রুতই কারখানাটি বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

পরিবেশবিদ সোমনাথ লাহেড়ী বলেন, জ্বালানী উৎপাদনে নিয়োজিত কারখানাগুলো আবাসিক এলাকায় নির্মাণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এ ধরণের কারখানার নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে গাছপালার পাতা পঁচে যাওয়াসহ ফসল ও ফলমূল উৎপাদন কবে যাবে। এছাড়াও মানবদেহ হবে নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত। বিশেষ করে শিশু, মহিলাসহ বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর হাঁপানী, ক্যান্সারসহ নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, আবাসিক এলাকায় জ্বালানী কারখানা নির্মাণের নিয়ম নেই। এছাড়াও মা বাবার দোয়া গ্রীণ অয়েল কারখানাটি নির্মাণ প্রসঙ্গে আমি অবগত নই। সরেজমিন পরিদর্শন করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

টাঙ্গাইল কল কারখানার উপ মহাপরিদর্শক মহর আলী বলেন, এ কারখানাটি পরিদর্শন করা হবে। নিয়মের কোন ব্যত্যয় পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জেলার সিভিল সার্জন ডা. মিনহাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, এ ধরণের কারখানায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। আবাসিক এলাকায় জ্বালানী কারখানা করা যাবে না। এছাড়া কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকদের অবশ্যই বিশেষ নিরাপত্তা পোশাক ব্যবহার করতে হবে।

জেলা প্রশাসক জসীমউদ্দীন হায়দার জানান, কারখানা করতে অবশ্যই ডিসি’র এনওসি লাগবে। তবে আবাসিক এলাকায় জ্বালানী কারখানা করতে জেলা প্রশাসন থেকে এনওসি দেয়া হয় না। কারখানাটির এনওসি আছে কিনা সে বিষয়টি সন্দেহজনক। তিনি এ ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *