গোপালপুর প্রতিনিধি: গোপালপুর উপজেলার স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর ভাশুরের নির্যাতনের শিকার হয়ে তিন মাস পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো জরিনা বেগম মঙ্গলবার ২৩ মে গোপালপুর হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে কন্যা সন্তান প্রসব করেন। নবজাতকের নাম রাখা হয় বহ্নিশিখা।
অসহায় জরিনা ও নবজাতককে দেখতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসফিয়া সিরাত এবং থানার ওসি মো. মোশারফ হোসেন হাসপাতালে দেখতে যান। তাকে ফুলের স্তবক দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মাসতুরা আমিনা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আলীম আল রাজী, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল মোমেন, প্রেসক্লাব সভাপতি জয়নাল আবদীনসহ সরকারি কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
জরিনা বেগম জানান, তার বাবার বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার বোয়ালী গ্রামে। বাবা বৃদ্ধ আব্দুল জলিল দিনমজুর আর মা রাহেলা ঝিঁয়ের কাজ করেন। ২০১৪ সালে গোপালপুর পৌরসভার ভূয়ারপাড়া গ্রামের আফাজ উদ্দিনের পুত্র বাস শ্রমিক চাঁদ মিয়ার সাথে পরিচয়।
পরিণয়ের সূত্র ধরে জরিনাকে বিনা কাবিনে বিয়ে করে ঢাকার সিদ্দিক বাজারের ভাড়াটে বাসায় নিয়ে তোলে চাঁদ মিয়া। এরপর দুই পুত্র সন্তানের জননী হয় জরিনা। দুই বছর আগে স্বামী চাঁদ মিয়া ঢাকায় কাজলী বেগম নামক এক মাদক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করলে জরিনার উপর নির্যাতন শুরু হয়। অত্যাচার সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি গোপালপুরের ভূয়ারপাড়া চলে আসেন জরিনা।
৮ মাস আগে জরিনা তৃতীয়বারের মতো গর্ভবতী হলে স্বামী চাঁদ মিয়া এক লক্ষ টাকা যৌতুক দাবি করে। নিঃস্ব বাবা-মার পক্ষে যৌতুক দেওয়া সম্ভব নয় জানালে বেদম মারপিটের পর তাকে তালাক দেওয়ার হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকা চলে যায় চাঁদ মিয়া। এরপর পরই মাদক মামলায় চাঁদ মিয়া জেলহাজতে যায়। এখনো সে জেলহাজতেই রয়েছে। চাঁদ জেলে যাওয়ার পর তার শশুর আফাজ উদ্দীন, শাশুড়ি আজিরন এবং ভাসুর সুজাসহ সবাই মিলে তার উপর নির্যাতন শুরু করে।
চার মাস আগে বেদম পিটুনি দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে জরিনাকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়। এরপর সন্তান সম্ভবা জরিনা পথে-ঘাটে ঘুরে মানুষের কাছে হাত পেতে এবং কখনোবা এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে পেটে ভাত জোটাতে থাকে।
গোপালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আলীম আল রাজী জানান, প্রায় তিন মাস আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় জরিনা হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। অপুষ্টির শিকার ও শীর্ণকায় জরিনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সেবা দেওয়া শুরু হয়।
সে তখন জানিয়েছিল পরিবারের কেউ তার পাশে দাড়াচ্ছে না। তাই তিনি মানবিক কারণে জরিনার পাশে দাড়ান এবং তাকে নিয়মিত চিকিৎসা ও ফলোআপের ব্যবস্থা করেন। এরপর টানা তিন মাস জরিনার ঠিকানা ছিল গোপালপুর উপজেলা হাসপাতাল।
এদিকে গত মঙ্গলবার সকালে জরিনার প্রসব বেদনা শুরু হলে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আলীম আল রাজী সীজার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। পঞ্চগড়ে তার বৃদ্ধ বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। শ্বশুর বাড়ির লোকজন সাফ জানিয়ে দেয় জরিনার পেটের সন্তান চাঁদ মিয়ার নয়। হাসপাতালে সীজার অপারেশনের নিয়মানুযায়ী কেউই তার স্থানীয় অভিভাবক হতে চাচ্ছিল না।
এমতাবস্থায় ডাঃ রাজী নিজেকে অভিভাবক হিসাবে লিখিত দিয়ে সীজারের ব্যবস্থা করেন। সিজার করেন ডাঃ নীরু শারমীন এবং এ্যানেসথেসিস্ট ডাঃ তসলিম উদ্দীন। জরিনা একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান লাভ করে। সীজারের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সকলের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা জরিনার উপর বাড়তি সেবা নিশ্চিত করেন।
ডাঃ আলীম আল রাজী আরও জানান, মানবিক কারণে তিনি অসহায় জরিনাকে টানা তিন মাস হাসপাতালে রেখে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা এবং সীজার করেছেন। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের সীমিত লোকবল এবং চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে হাজারো মানুষকে প্রতিদিন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে গোপালপুর হাসপাতাল এখন আধুনিক চিকিৎসায় অবদান রেখে যাচ্ছে।
গোপালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসেন জানান, জরিনার জীবন কাহিনী বড়ই বেদনাদায়ক। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তাকে মানবিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে ধন্যবাদ কুড়িয়েছেন। এভাবে সবাইকে অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে হবে। জরিনার দুই পুত্র সন্তাকে কেড়ে নিয়ে নির্যাতনের পর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা শুনেছেন। তার দুই পুত্র সন্তান কোথায় আছে তা বের করা হবে।
শত অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করলেও জরিনা কখনোই থানা পুলিশে অভিযোগ করেনি। এখন পুলিশ জরিনার পক্ষে সব আইনগত সহযোগিতা দিবে। জরিনার শ্বশুরবাড়ির কেউ এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে চায়নি।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসফিয়া সিরাত জানান, খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে জরিনাকে দেখতে যান। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে এ জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান। স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি এখন স্থানীয় প্রশাসনও অসহায় জরিনার পাশে দাড়িয়েছে। এরপর তাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা হবে। সবাই মিলে জরিনার নবজাতকের নাম রেখেছে বহ্নিশিখা। পুস্পস্তবক ছাড়াও নবজাতক ও প্রসূতির জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ও নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী উপহার দেন তিনি।