মধুপুর প্রতিনিধি: মধুপুর উপজেলার গরিবের চিকিৎসক ডা. এড্রিক বেকার প্রতিষ্ঠিত কাইলাকুড়ী নামক প্রত্যন্ত গ্রামে ‘কাইলাকুড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রে আজো সমানভাবে গরিবরা চিকিৎসা পাচ্ছেন। ‘ডাক্তার ভাই’ হিসেবে পরিচিত বেকার মারা যাওয়ার পর সেখানে দায়িত্ব নিয়েছেন আমেরিকান দম্পতি জেসন-মারিন্ডি।
জানা যায়, টানা ৩২ বছর গ্রামের দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দেয়ার পর দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তার তৈরি করা হাসপাতালেই তিনি ২০১৫ সালে মারা যান। হাসপাতালের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে সারাজীবন থেকে যান চিরকুমার।
মৃত্যুর আগে তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশী কোনো ডাক্তার যেন গ্রামে এসে তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের হাল ধরেন। কিন্তু এ দেশের একজন ডাক্তারও তার সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তবে দেশের কেউ সাড়া না দিলেও এড্রিক বেকারের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন আমেরিকার এক হৃদয়বান চিকিৎসক দম্পতি জেসন ও মারিন্ডি।
ডা. এড্রিক বেকার বেঁচে থাকার সময় কালিয়াকুড়ির এই হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছিলেন। পরবর্তীতে ডাক্তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে জেসন অস্থির হয়ে উঠেন। কিন্তু তখন নিজের প্রশিক্ষণ ও ছেলেমেয়েরা ছোট থাকার কারণে জেসন বাংলাদেশে আসতে পারেননি।
অবশেষে সবকিছু গুছিয়ে সম্পদ আর সুখের মোহ ত্যাগ করে ২০১৮ সালে পুরো পরিবার নিয়ে আমেরিকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে আসেন মধুপুরে।জেসন হয়ে উঠেন নতুন ডাক্তার ভাই আর মারিন্ডি হয়ে উঠেন ডাক্তার দিদি।
বাংলাদেশে আসার সময় নিজেদের সন্তানদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তারা। ইতিমধ্যে ভর্তি করে দিয়েছেন গ্রামেরই স্কুলে। তারা গ্রামের শিশুদের সঙ্গে লেখাপড়া ও খেলাধূলা করে। অবসরে ডাক্তার জেসিনও লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান। তাদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশী ফল ও খাবার।জেসন-মারিন্ডি বাংলায় কথা বলতে পারেন। সন্তানদেরও বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন এই দম্পতি।
কাইলাকুড়ী গ্রামে চার একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালে মাটির ছোট ছোট ২৩টি ঘরে হাসপাতালের ডায়াবেটিক, শিশু, ডায়রিয়াসহ ৭টি বিভাগে ৪০ জন রোগী ভর্তির ব্যবস্থা আছে। এছাড়া প্রতিদিনই আউটডোরে শতাধিক রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়।
এদিকে ডাক্তার বেকারের মৃত্যুর পর এই হাসপাতালের ৯০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকারের নির্দেশনা মোতাবেক হাসপাতালের হাল ধরেন। বর্তমানে হাসপাতাল চলছে ডাক্তার বেকারের স্মৃতি নিয়ে। প্রতিদিনই দরিদ্র রোগীরা আসছেন আর চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। নতুন রোগীদের জন্য ২০ টাকা আর পুরাতনদের জন্য ১০ টাকা করে ফি নেয়া হচ্ছে।
কাইলাকড়ী গ্রামের সুমেত আরা বলেন, আমরা কীভাবে কঠিন ও জটিল রোগ থেকে বাঁচতে পারি সেসব আমরা এই হাসপাতাল থেকে জানতে পারি। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা তা আমাদের বাড়িতে ব্যবহার করি। আর এতে করে আমার পবিবার অনেক ভালো আছি।
এদিকে তার মৃত্যুর পর হাসপাতালটি চালাচ্ছেন তারই আদর্শের অনুসারীরা। বেকারের অভাব বেশখানিকটা পূরণ করেছেন জেসন-মারিন্ডি দম্পত্তি। এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে প্রতিদিন রোগীদের প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়।
কাইলাকড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী সুজিত রাং সা বলেন, ডাক্তার বেকারের তিনটি শেষ ইচ্ছার মধ্যে দুইটি পূরণ হয়েছে। এই হাসপাতালটি টিকিয়ে রাখাই ছিল তার শেষ ইচ্ছা। তাই প্রতিষ্ঠানটির সেবা অব্যাহত রাখতে সরকারের সহযোগিতা চাইলেন এই কর্মকর্তা।
কাইলাকুড়ী স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক পিজন নংমিন বলেন, প্রথম দিকে এ এলাকার মানুষ বিভিন্ন রোগে মানুষ মারা যেতো। কিন্তু এখন আমরা এ রোগগুলো মনে করি খুব সাধারণ, কিন্তু ওই সময়ে মরণব্যাধী ছিল। তিনি এ এলাকায় স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করতেন এসব রোগে থেকে মানুষ কেন মারা যাবে। তারপর দেখা যায়, দিনদিন এ স্বাস্থ্য কেন্দ্র বড় হতে থাকে।
কাইলাকুড়ী এ হেলথ কেয়ার প্রজেষ্টে ১৯৯৬ সালে তিনি সাব সেন্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে এটি বড় হতে থাকে। বর্তমানে এ এলাকার মানুষ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকেন। আমরা এখানে শুরু মাত্র প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা করি, মেজর কোন কিছু করি না। মেজর কোন কিছু থাকলে তাদেরকে আমরা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করি। এখানে ৯০ জন স্টাফ দু’জন দেশী, দু’জন বিদেশী ডাক্তার রয়েছে।
হাসপাতালের ডা. নুরুন নাহার সুমি বলেন, আমি গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের একজন ডাক্তার। আমাদের হাসপাতাল থেকে ২ মাস পর পর এখানে ডাক্তার পাঠায়। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি ৪ মাস যাপত কাজ করছি। নতুন ডাক্তার দম্পতির সাথে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। তাদের অভিজ্ঞতা এবং আমাদের অভিজ্ঞতা অনেকটাই আলাদা। তাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আর আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। আমরা একে অপরের সাথে আলোচনা করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। এতে রোগীরা অনেক ভালো চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন।
গরিবের নতুন ডাক্তার ভাই ডা. জেসন বলেন, ডা. এড্রিক বেকার বেঁচে থাকার সময় কাইলাকুড়ির এই হাসপাতালটিতে আমি পরিদর্শনে এসেছিলাম। পরে ডাক্তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনি। কিন্তু তখন নিজের প্রশিক্ষণ ও ছেলে-মেয়েরা ছোট থাকার কারণে আসতে পারিনি। অবশেষে সব কিছু গুছিয়ে সম্পদ আর সুখের মোহ ত্যাগ করে ২০১৮ সালে পুরো পরিবার নিয়ে আমেরিকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে আসি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। আর আমরা ‘নতুন ডাক্তার ভাই’ ও ‘মারিন্ডি দিদি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠি।
তিনি আরো বলেন, গ্রামের স্কুলে আমাদের সন্তানদের ভর্তি করে দিয়েছি। তারা গ্রামের শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা ও খেলাধুলা করে। এখানে এসে আমার খুব ভালো লাগছে। গরীব মানুষদের জন্য কাজ করছি। এখানে অনেক কর্মী এবং রোগী রয়েছে। ডাক্তার ভাইয়ের মতো আমরাই গরীর মানুষদের জন্য কাজ করতে চাই।
উল্লেখ্য, সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসে দরিদ্র মানুষের সেবা করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা তা নজিরবিহীন বলেও মনে করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলছেন, আমরা সুযোগ পেলেই গ্রাম থেকে শহরে ছুটি। শহর থেকে বিদেশ পাড়ি দেই। শিশু জন্মের পর থেকেই চিন্তা থাকে কত দ্রুত সন্তানকে আধুনিক মিডিয়াম ইংরেজি স্কুলে বাচ্চাকে পড়াব। এ হাসপাতালটি পাহাড়ি ওই অঞ্চলের সাধারণ গরিব ও দুখী মানুষের একমাত্র চিকিৎসা মাধ্যম। তাই প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে সরকারের জরুরিভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।