নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে সকল ক্ষেত্রে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চললেও রাজনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে গিয়ে ক্রমেই পশ্চাৎগামী হচ্ছে। অথচ এক সময় জাতীয় রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল এই জেলা। অথচ দিনদিনই পিছিয়ে এসে জেলার রাজনৈতিক প্রাচীন ঐতিহ্য ক্রমেই ম্লান হচ্ছে।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মতো এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন শীর্ষ নেতা। যাদের নেতৃত্বের বলিষ্ঠতায় তত্কালীন রাজনীতিতে আসে পরিবর্তন। স্বাধীনতার পর আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের মতো নেতা প্রভাব বিস্তার করেছেন দেশের জাতীয় রাজনীতিতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখা জেলার রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা। সমসাময়িক জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব হারিয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতিকদের উপস্থিতি এখন হাতেগোনা পর্যায়ে চলে এসেছে।
পাকিস্তান আমলে তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মুখে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। যেখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুটি প্রধান দায়িত্ব নিয়ে দলের সম্মুখ সারির নেতৃত্ব দেন টাঙ্গাইলের দুই প্রভাবশালী নেতা। ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের “আস্ সালামু আলাইকুম” বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরেন শামসুল হক। যিনি একাধারে ভাষাসৈনিক ও তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম এবং তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাদের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ দলকে আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে এই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
রাজনীতির মাঠে টাঙ্গাইলের নেতাদের লড়াইয়ের শুরুটা হয়েছে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে। খেলাফত কিংবা অসহযোগ সব আন্দোলনেই তারা প্রভাব বিস্তার করেছেন। তেমনই একজন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য এবং ১৯৫৩ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় টাঙ্গাইলের অনেক জমিদারও নেতৃত্ব দেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। আরেকজন ছিলেন করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী। সামাজিক ও রাজনৈতিক কৃতিত্বের জন্য এ নেতা মানুষের কাছে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন ‘আটিয়ার চাঁদ’ নামে। ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস কমিটি ও নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি রাজনীতিতে অবদান রাখেন। ময়মনসিংহ জেলা খিলাফত কমিটি গঠন করে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খাটেন এ নেতা।
অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী ছিলেন টাঙ্গাইলের আরেক রাজনীতিক স্যার আবদুল করিম গজনবী। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে প্রতিরোধের মাধ্যমে রাজনীতিতে আগমন করেন। যিনি পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় অবদান রাখেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে হার্টগ কমিটিতে সাক্ষ্য প্রদানকালে আবদুল করিম গজনবী বাংলাকেই বাঙালির সর্বজনীন মাতৃভাষা হিসেবে অভিহিত করেন। তারই সহোদর আবদুল হালিম খান গজনবীও ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় অবদান রাখেন।
ষাটের দশকে মওলানা ভাসানীর প্রভাব বলয়ে যুক্ত হয় বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও। বাম দলগুলোর রাজনীতি আবর্তিত হয় ভাসানীকে কেন্দ্র করে। প্রায় দুই দশক ধরে দেশের রাজনীতিতে তিনি নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মওলানা ভাসানী ছাড়াও পাকিস্তান আমলেও টাঙ্গাইল থেকে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা রাজনীতির মাঠে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যারা পাকিস্তান পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলনের সময়ও দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাখেন বীরত্বসূচক অবদান। আলীম আল রাজী ছিলেন তেমনই একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। যিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার জন্য সবসময়ই ছিলেন সোচ্চার। ভাষাসৈনিক হিসেবে অবদান রাখেন ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম। প্রগতিশীল রাজনীতির ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবদান রেখেছিলেন আরেকজন সংগ্রামী কৃষক নেতা হাতেম আলী খান।
টাঙ্গাইল থেকে আসা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবদানসহ সত্তরের দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেও পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদ হিসেবে তেমন প্রতিষ্ঠা পাননি। এছাড়া, টাঙ্গাইলের জননেতা আব্দুর মান্নান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালক, মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক, সাবেক স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। জেলার আরেক খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শাহজাহান সিরাজ মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম ছাত্রনেতা ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক ছিলেন; পরবর্তীতে তিনি মন্ত্রীত্বও লাভ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে সমরনায়ক হিসেবে রাখেন অবদান। পেয়েছেন বঙ্গবীর উপাধি, বীরউত্তম খেতাব। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি গঠন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং ক্রমেই শীর্ষ স্থান থেকে দূরে সরে আসেন।
বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে জাতীয় নেতা বলতে শুধু কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাককেই বোঝায়। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
টাঙ্গাইলের রাজনীতি নিয়ে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত সহকারী ও হক কথার সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী বলেন, ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আহ্বানে রাজনীতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের হয়ে অবদান রাখেন ভাসানী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসংখ্যবার ভাসানীর কাছে গিয়েছেন। সে সময় আইয়ুব খানের সঙ্গে চারবার পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে যান। যদিও পরবর্তী সময়ে আইয়ুব খানই মওলানা ভাসানীকে চার বছর জেলে বন্দি রাখেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তার আলাদা জায়গা তৈরি হয়। বাম রাজনৈতিক নেতা মণি সিংহ, কমরেড মোজাফফর আহমদ, আবদুল হক, তোহাসহ অন্যরা ভাসানীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনা করতেন। সে সময় ভাসানীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন আবুল হাশিম।
পাকিস্তান আমলে এমন কোনো নেতা ছিলেন না যে কিনা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেননি। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও তিনি প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠেন। তত্কালীন চীনা রাষ্ট্রপ্রধানের আহ্বানে ভাসানী চীন ভ্রমণে যান। সাম্প্রতিক সময়ে শুধু টাঙ্গাইলই নয়, পুরো বাংলাদেশেই এমন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে আদর্শভিত্তিক রাজনীতিক না থাকায় জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের নেতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে।’
সমসাময়িক জাতীয় রাজনীতিতে এ অঞ্চলের প্রভাব হারানোর কারণ সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা ও কবি বুলবুল খান মাহবুব বলেন, ‘টাঙ্গাইলে একসময় মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকদের মতো নেতা ছিলেন। তারা ছাত্রজীবন থেকেই আদর্শ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতি করেছেন। সেই আদর্শের ওপরই নিজেদের ভিত গড়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরই সেই গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে মানুষ ছিটকে পড়ে, তাই আর তেমন জাতীয় রাজনীতিবিদ এখন দেখা যায় না। টাঙ্গাইলের বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও তাদের আদর্শ থেকে সরে গেছে। বাম নেতাদের সামনে সুখেন্দু দস্তিদার বা তোহাদের মতো আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা নেই। জনগণের মধ্যে তাদের ভিত্তি নেই। যদিও টাঙ্গাইল থেকে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক আছেন। কিন্তু রাজনীতিতে শীর্ষ পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করার মতো আর কোনো নেতা নেই।’
টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির বলেন, ‘এটি খুব দুঃখের বিষয়। গত ২৫ বছর আমাদের এলাকায় কোনো নতুন নেতা তৈরি হয়নি। আওয়ামী লীগের কিছু মানুষের জন্য সে পথটি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। এখন আমরা সেটি নিয়ে কাজ করছি। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে অনেক গুছিয়ে এনেছি। নতুন নেতা তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।’