নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সিদ্দিকী পরিবার। বিশেষ করে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, লতিফ সিদ্দিকী ও মুরাদ সিদ্দিকীকে নিয়ে চলছে ব্যাপক গুঞ্জন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ করার পর রাজনৈতিক মহলে আরো বেশি আলোচনা শুরু হয়েছে।
এদিকে, গত ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের শহীদ মিনারে কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর নিকট অস্ত্র সমর্পণ দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর আমন্ত্রণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক এবং সংসদ সদস্য মৃনাল কান্তি দাস উপস্থিত ছিলেন।
এই অনুষ্ঠানের পর থেকেই আওয়ামী লীগ অথবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে কাদের সিদ্দিকী যাচ্ছেন এটি সর্বত্র আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত লতিফ সিদ্দিকী ও ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকী উপস্থিত থাকলেও আরেক ভাই মুরাদ সিদ্দিকী অনুপস্থিত ছিলেন।
টাঙ্গাইলের রাজনৈতিক নেতারা ধারণা করছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সমঝোতা হবে। তবে লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের ফিরবেন নাকি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ থেকে নির্বাচনে অংশ নিবেন তা জানা যায়নি।
এছাড়া, মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে যোগদান ও জেলা কমিটিতে পদপ্রাপ্তির বিষয় নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তাকে জেলা কমিটিতে সুযোগ দিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন বলে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন। কিন্তু জেলার কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং জেলা পর্যায়ের বড় একটি অংশ মুরাদ সিদ্দিকীকে দলে নেওয়ার ঘোর বিরোধীতায় রয়েছেন বলেও জানা গেছে।
মুরাদ সিদ্দিকী কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই। আগামীতে জেলা আওয়ামী লীগের পুর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত করা হলে মুরাদ সিদ্দিকী জেলা আওয়ামী লীগে পদ পাচ্ছেন, নাকি এবারও দলে ঢুকতে ব্যর্থ হচ্ছেন-এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা জানান, ১৯৯৯ সালে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে নতুন দল গঠন করেন। মুরাদ সিদ্দিকী তখন কাদের সিদ্দিকীর দলে যোগ দেন।
২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। তারপর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের রাজনীতি থেকে নিস্ক্রিয় হয়ে যান। ২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি টাঙ্গাইল-৫ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। তবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী হিসেবে নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
মূলত ২০০৯ সাল থেকে মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে যোগদানের চেষ্টা করছেন। ২০১৫ সালে মুরাদ সিদ্দিকীর অনুসারী টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান মিরনসহ অনেকেই আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তারা পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগে পদপদবিও লাভ করেন। কিন্তু মুরাদ সিদ্দিকী যোগদান করতে ব্যর্থ হন। দলে ঢুকতে না পারলেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং দলীয় কার্যালয়ে মুরাদ সিদ্দিকী যাতায়াত শুরু করেন।
গত বছরের ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মুরাদ সিদ্দিকী বড় মিছিল নিয়ে অংশ নেন। ওইদিন সম্মেলনে ফজলুর রহমান খান ফারুককে সভাপতি এবং সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলামকে (ভিপি জোয়াহের) সাধারণ সম্পাদক করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হবে কয়েক দিনের মধ্যে। ওই কমিটিতে মুরাদ সিদ্দিকী স্থান না পেলেও হাল ছাড়ছেন না তিনি।
সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ২০১৪ সালে আচমকা ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে জড়িয়ে যান ভয়াবহ বিতর্কে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলেকে নিয়েও কটাক্ষ করেন তিনি। টিভি টকশোর আলোচকদের ‘টকমারানি’ বলে বিদ্রূপ করে পড়েন মহা সমালোচনায়। ওই ঘটনার পর মুহূর্তেই চলে যায় তার মন্ত্রীত্ব। হারান সংসদ সদস্য পদ। ছিটকে পড়েন দল থেকেও।
মুরাদ সিদ্দিকীর অনুসারীরা জানান, একটি মহল মুরাদ সিদ্দিকীর দলে যোগদান ঠেকাতে তৎপর। তাদের ‘অপতৎপরতা’র কারণেই তাঁর নাম কমিটিতে রাখা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সবুজ সংকেত আছে। এ জন্যই মুরাদ সিদ্দিকী হতাশ নন। তিনি হাল ছাড়েননি। রোজার মাসে টাঙ্গাইল সদর ও কালিহাতীতে বেশ কয়েকটি ইফতার মাহফিল ও মতবিনিময় সভা করেছেন তিনি।
মুরাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের আদর্শের বাইরের কেউ নই। সবসময় সব অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছি। আওয়ামী লীগের সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করছি। দল যদি আমাকে কোনো দায়িত্ব দেয় তা পালন করার জন্য প্রস্তুত আছি। এ জেলার কৃতি সন্তান দলের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, দলের জেলা শাখার সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক, সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমি কাজ করতে চাই।’
মুরাদ সিদ্দিকী আরো বলেন, ‘দলে স্থান পেলে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। আওয়ামী লীগে কাজ করার সুযোগ পাব। এ ব্যাপারে এখনো আমি আশাবাদী।’
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে জেলার নেতাদের বলা হয়েছে মুরাদ সিদ্দিকীকে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে রাখার জন্য। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ এবং কয়েকজন সংসদ সদস্য চান না মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে পদ লাভ করুক। তারা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুরাদ সিদ্দিকীর পদ লাভ ঠেকাতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানান নেতারা।
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ও কয়েকজন সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ ভালো অবস্থায় রয়েছে। মুরাদ সিদ্দিকীকে দলীয় পদ দেওয়া হলে আবার একটি নতুন বলয় সৃষ্টি হতে পারে। তাই তারা এই মুহূর্তে মুরাদ সিদ্দিকী দলে আসুক তা চান না। তিনি দলে এলে টাঙ্গাইল সদর অথবা কালিহাতী আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তার যোগদান ওই আসন দুটির বর্তমান সংসদ সদস্যদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার খোকা বীরপ্রতিক বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কথা চলছে। তবে মুরাদ সিদ্দিকী আমাদের দলের কেউ না।’
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম (ভিপি জোয়াহের এমপি) বলেন, ‘মুরাদ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগে যোগদানের চেষ্টা করছেন, এটা সত্য।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আযম আলোচনা সাপেক্ষে তাকে নেওয়া যেতে পারে বলে কিছুটা সন্মতি প্রকাশ করেছেন। দলের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক সাহেব আছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’