নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের বিসিক শিল্পনগরী নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট, খানাখন্দে ভরা সড়ক, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ সংকটের অন্ত নেই প্রতিষ্ঠানটির। পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিসিক শিল্পনগরী। পানি বাড়লে প্লাবিত হয় রাস্তাঘাট ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামোর উন্নয়ন করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বিসিক সূত্রে জানা যায়, বিগত ১৯৮৫ সালে সদর উপজেলায় তারটিয়া এলাকায় ২৩ দশমিক ৫০ একর জমির উপর বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। এতে বরাদ্দযোগ্য প্লটের সংখ্যা এ-টাইপ ৭২টি, বি-টাইপ ১২টি, সি-টাইপ ৩৪টি, সাব-কানেক্টিং ১৪টি। সর্বমোট ১৩২টি সবকটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিল্প ইউনিটের সংখ্যা উৎপাদনরত ৫৬টি, নির্মানাধীন ৪টি, নির্মাণের অপেক্ষায় ৩টি এবং রুগ্ন/নিস্ক্রিয় আছে একটি। শিল্প উদ্যোক্তারা এতে প্রায় বিনিয়োগ করেছেন ১০২ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা। এখানে মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা।
এখানে ক্যামিক্যাল, ফ্লাওয়ার মিলস, পেপার মিলস, স্কয়ার বার ফুড, এ্যালুমিনিয়াম কিচেন ওয়ার, ওয়েস্টেজ পেপার, ইঞ্জিনিয়ারিং, অক্সিজেনসহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও ভাল রাস্তাঘাট নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ৮৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। অবকাঠামোর উন্নয়ন না হলে ব্যবসায়ীরা বিসিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। ফলে বেকার হয়ে পড়বে শত শত কর্মী।
বিসিকের একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করা নারী শ্রমিক কল্পনা আক্তার বলেন, বিসিকের রাস্তার অবস্থা এতো খারাপ যে হেঁটে চলা দায়। বৃষ্টি নামলে রাস্তায় হাটু পানি হয়, তখন কাপড় ভিজিয়ে অফিসে আসতে হয়। এখানে রাস্তার উপরে বাজার বসার কারণে হাটাঁচলা কষ্ট হয়।
ট্রাক ড্রাইভার নাজিম হোসেন বলেন, বিসিকে আমাকে প্রতিদিনই আসতে হয়। কিন্তু রাস্তার অবস্থা এতোটাই খারাপ যে যাতায়াতের অনেক সমস্যা হয়। রাস্তা খারাপের কারণে গাড়ির অনেক ক্ষতি হয়। মাঝে মাঝে গাড়ির পাতি ভেঙ্গে যায়, যার দাম প্রায় ৪ হাজার টাকা। রাস্তার কাজ তাড়াতাড়ি করলে আমরা যারা গাড়ি চালাই আমাদের জন্য ভাল হয়।
টাঙ্গাইল বিসিক নগরীর প্রতিষ্ঠানের ভেগান ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড ফ্যাক্টরি ম্যানেজার জাবেদ ইকবাল বলেন, আমার বিভিন্ন এরিয়াতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। টাঙ্গাইল বিসিকের পরিবেশ শোচনীয়, এখানে ময়লা ফেলানোর কোন ব্যবস্থা নাই। আমাদের ফ্যাক্টরির পাশেই একটি রাস্তা আছে, পুকুরের মতো এটি একটি ডোবা মনে হয়। এখান দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করতে পারে না। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে এ অবস্থা। আমাদের এখানে একটি হাট হয় সপ্তাহের প্রতি রবিবার। এই হাটেঁর দিন এমন অবস্থা হয় বিসিকের ভিতরে ফ্যাক্টরির সামনে চলে আসে মাল ডেলিভারি করতে অনেক সমস্যা হয়।
প্রিয়া ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিক শফিক আনসারী বলেন, আমি দীর্ঘদিন যাবত এখানে আছি। আগে রাস্তা নিচু ছিল, এখন রাস্তায় মাটি ফেলে উচু হওয়ার জন্য একটু বৃষ্টি হলে পানি ফ্যাক্টরীর ভিতরে ঢুকে যায়। ড্রেনেজের ব্যাপারে বিসিকে আমি অনেকবার বলছি যে সরকারি মোবাইল কোর্ট দিলে জরিমানা করে এজন্য আমি বাধ্য হয়ে ভিতরে মোটর বসিয়ে ফ্যাক্টরির পানি নিস্কাশন করি। প্রতি রবিবার হাট বসে বিসিকের ভিতর ঢুকে রাস্তার মধ্যে বসে দোকান করে এদের কিছু বলাও যায় না। এজন্য আমাদের গাড়ি ও লোকজন চলাচলা সমস্যা হয়ে যায়। আমি এ ব্যাপারে কয়েকবার বিসিক অফিসে বলার পরও ডিসি অফিসেও অবগত করি। ডিসি অফিসের অনুমতিক্রমে সাইন বোর্ড লাগাই যাতে হাটেঁর লোকজন বিসিকের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয় নাই।
বন্ধন ফ্যাক্টরির মালিক বাদল সরকার বলেন, আমরা দীর্ঘদিন যাবত বিসিকে ব্যবসা পরিচালনা করছি। ব্যবসা পরিচালনা করতে দেখা গেছে বিসিকের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভাল না, লাইট ব্যবস্থা ভাল না, সিকিউরিটি নাই। ইদানিং আবার একটি বড় ধরনের ডিস্টাব হইছে শিল্প এলাকায় বাজার প্রতি রোববার সপ্তাহে একদিন হাট হয়, প্রতিদিন বাজার হয়। এজন্য পিকআপ বা অন্যান্য গাড়ি যাতায়াত করতে সমস্যা হয়। বিসিক শিল্প এলাকা বাজার মুক্ত করা হোক।
বিসিক শিল্পনগরীর মেসার্স রাবেয়া ফ্লাওয়ার এন্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের যে উন্নয়নে বিসিক যে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে, বিসিকে যে পণ্য উৎপাদন করা হয় তা যদি যাতায়াতের কারণে সময়মত ডেলিভারি না করা যায় তাহলে উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটবে। বিসিকের যে রাস্তা, রাস্তাঘাটের যে অবস্থা ঠিকমতো লোকজন ও গাড়ি চলাচল করতে পারে না।
তারটিয়া বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক রায়হান খান বলেন, বিসিক শিল্পনগরী হওয়ার অনেক আগে থেকেই এ বাজার বসছে। বাজারটি উচ্ছেদের জন্য বিসিক কর্তৃপক্ষ অনেকবার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি উচ্ছেদ হলে এলাকার অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে এবং কেনাকাটা করতে সমস্যা হবে। বিসিকের ভিতরে রাস্তায় বাজার নিয়ে কেনাবেচা না করে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করবো।
টাঙ্গাইল বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ইকবাল হোসেন খোকন বলেন, টাঙ্গাইল বিসিক শিল্পনগরীর রাস্তাঘাটের অবস্থা এতোটাই বেহাল যে, এখান দিয়ে যেকোন গাড়ি চলাচল করানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা, আয়রণ সমস্যা, গ্যাস সংযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগসহ পর্যাপ্ত সমস্যা আছে। বিসিক শিল্পনগরীতে প্রবেশ পথ নিয়ম মাফিক একটি গেট থাকলেও বাস্তবে এলাকার লোকজন কয়েকটি পকেট গেট তৈরি করে বিসিক শিল্পনগরীর রাস্তা ব্যবহার করছে।
এছাড়া বিসিক শিল্পনগরীর শিল্প প্লটের ভিতরে একটি বাজার গড়ে উঠেছে এবং সেখানে একদিন হাট বসে। শিল্প প্লটটি পুরোপুরি বাজারে রুপান্তিত হয়েছে আর হাটের পরিধি পর্যায়ক্রমে বিসিক শিল্পনগরীর রাস্তার অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে। ফলে বিসিক শিল্পনগরীর ঐ অংশে শিল্প কারখানাগুলোর যানবাহন হাটের দিন যাতায়াত করতে পারছে না। অন্যদিকে বিসিক শিল্পনগরী নিরাপত্তাহীনতার সম্মূখীন হচ্ছে।
বিসিক শিল্পনগরীর টাঙ্গাইলের কর্মকর্তা জামিল হুসাইন বলেন, আমাদের বিসিকের রাস্তাঘাট ও ড্রেনের বর্তমান সমস্যা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হবে। আমরা ইতিমধ্যে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার বাজেট পেয়েছি। এই অর্থবছরেই রাস্তাঘাট এবং ড্রেনকালবার্টের কার্যক্রম শুরু করতে পারবো। এলাকাবাসির দাবি এ বাজার মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে হাটবাজার এখানে বসছে এজন্য এ বাজার তাদের। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে অচিরেই কাজ শুরু হবে।
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহন আনসারী বলেন, টাঙ্গাইল শহরের পুর্ব পাশে বিসিক তারটিয়া যে সময় সরকার জমি ভূমি অধিকরণ করেন তার আগে থেকেই সেখান হাট বসে। ওই হাট সহকারে সরকার অধিকরণ করে বিসিক যাদের জায়গা বরাদ্ধ দিয়েছে। হাটের কারণে ওই জায়গা বিসিক বরাদ্ধকৃত জায়গা বুঝিয়ে দিতে পারে নাই। আমি চাই টাঙ্গাইল শহরের পূর্বপান্তে পুর্বাঞ্চলে বিসিক এবং শহরতলীর লোকজনের জমজমাট বাজার বসে বাজারটি টিকে থাকুক। বিসিকের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিসিকের আলাদা বরাদ্দ আছে প্রায় এক কোটি টাকার উপর বরাদ্দ আসছে।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ওলিউজ্জামান বলেন, বিসিকের বিষয়ে আমার কাছে নতুন কোন তথ্য জানা নেই। যেহেতু এখানে ভূমি মাপের বিষয় আছে, বিসিক এবং স্থানীয় উভয়পক্ষের লোকজন নিয়ে বসে মাফজোক করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।