টাঙ্গাইলের নদী-খাল-বিল দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে

টাঙ্গাইল পরিবেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের এক সময়ের খরস্রোতা নদ-নদীগুলো দখল, দূষণ ও অবৈধভাবে ড্রেজিয়ের কারনে এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। ‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’- এই প্রবাদেই পরিচয় মেলে এক সময়ের টান-আইল তথা টাঙ্গাইলের। কিন্তু কালের আবর্তে এ প্রবাদটি হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই নদী চর খাল বিল এখন আর কোথাও তেমন একটা চোখে পড়ে না।

ক্রমাগত দখল দূষণ আর ভরাট হয়ে টাঙ্গাইল জেলা দিয়ে প্রবাহিত নদী, শাখা নদী ও খাল বিলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচ দিয়ে এখন চর জেগে উঠেছে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় মিল-কারখানার বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে জলজ প্রাণি প্রায়ই নদীতে ভেসে উঠছে। স্থানীয়দের অসচেতনতা ও প্রভাবশালীদের দখলী প্রতিযোগিতায় নদী-খালগুলো ঘর-বাড়ি, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও আবাদি জমিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। জেলার নদী ও খাল বিল দিয়ে এখন আর পাল তুলে নৌকা চলতে দেখা যায় না।

জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া ১০টি বড় নদীর মধ্যে শুধুমাত্র যমুনা এখনও তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। ধলেশ্বরী, বংশাই, লৌহজং, খিরু, যুগনী, ফটিকজানি, এলেংজানি, লাঙ্গুলিয়া ও ঝিনাই এবং শাখা নদীগুলো দখল-দূষণে খালে পরিণত হচ্ছে। অথচ এসব নদীগুলোই এক সময় জীবনাচারের নিত্য সঙ্গী ছিল।

জানা যায়, বংশী বা বংশাই নদী পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। এটির দৈর্ঘ্য মোট ২৩৮ কিলোমিটার। নদীটি জামালপুর জেলার শরীফপুর ইউনিয়ন অংশে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলা অতিক্রম করে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি সাভারের কর্ণতলী নদীর সাথে মিলে কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে আমিনবাজারে এসে তুরাগ নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। তুরাগ নদী আরো কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। বংশাই নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৩৮ কিলোমিটার। এ নদী চারটি জেলা যথাক্রমে জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকা এবং ১০টি উপজেলা যথাক্রমে জামালপুর সদর, মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী, বাসাইল, মির্জাপুর, সখিপুর, কালিয়াকৈর, ধামরাই, সাভার এবং ৩২১টি মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

ঝিনাই নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের শেরপুর, জামালপুর এবং টাঙ্গাইল জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭৬ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং-২১। ঝিনাই নদী জামালপুরের বাউশী থেকে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে একটি শাখা ডানদিকে বেঁকে যমুনার পূর্ব পাশ দিয়ে ভূঞাপুর উপজেলার ৭ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে কালিহাতী উপজেলার জোকার চরে ধলেশ্বরীর উৎসমুখের কাছে মিলিত হয়েছে। অপর শাখা দক্ষিণ-পূর্বমূখী হয়ে বাসাইল উপজেলার ফুলকী হয়ে বংশাই নদীতে পতিত হয়েছে। অন্য অংশ দক্ষিণমুখী হয়ে বাসাইলের ফুলকী-আইসড়া, দেউলী, দাপনাজোর, নথখোলা হয়ে দক্ষিণমুখী হয়েছে।

প্রমত্তা যমুনা-ধলেশ্বরী বেষ্টিত ব’দ্বীপ বিশেষ নাগরপুর উপজেলা। জনশ্রুতি আছে, সুলতান মাহমুদশাহ’র শাসনামলে নাগরপুরের মামুদনগর ছিল তাঁর রাজধানী। সেখানে তাঁর একটি বিশাল এক নৌঘাটি ছিল। বিদেশি শত্রুর আক্রমনের হাত থেকে ওই অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্যেই সম্রাট মাহমুদ শাহ ওই নৌ ঘাটি নির্মাণ করেছিলেন। এক সময় বর্তমান সিরাজগঞ্জের চৌহালীর পূর্বাংশ- নাগরপুর এবং দৌলতপুরের অংশ বিশেষসহ পুরো এলাকা ছিল নদী এলাকা। কালের বিবর্তনে ওই এলাকা চর এলাকায় রূপ নেয়। নাগরপুরের নোয়াই নদীর দুই পাড় ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে।

মির্জাপুরের হাটুভাঙ্গা এলাকায় নদী দখল করে ১০-১৫টি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। বাসাইলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশাই নদীর দুই পারে গড়ে উঠেছে ইটভাটা ও রাইসমিল। লাঙ্গুলিয়া নদী পাড়ের বিশাল এলাকা জুড়ে বানানো হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। অনেক জায়গায় বাঁধ দিয়ে চলছে মাছ চাষ।কালিহাতীর বংশাই, সাপাই, ঝিনাই, ফটিকজানি, লাঙ্গুলিয়া ও নাংলাই নদীর দু’পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ঘর-বাড়ি, মিল-কারখানা ইত্যাদি।

গোপালপুর উপজেলা সদরের বৈরান নদীর অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। শুস্ক মৌসুমে নদীর তলদেশে পুরোটাই বোরোর আবাদ হয়। গোপালপুর পৌরসভার অংশে নদীর উভয় পাড় দখল করে বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে ভূমিদস্যুরা।

ভূঞাপুর ও বাসাইল উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝিনাই ও বংশাই নদী। বাসাইলের লাঙ্গুলিয়া নদী, মধুপুরের টোকনদী, গোপালপুরের বৈরান নদী, কালিহাতীর নিউ ধলেশ্বরী, এলেংজানি, ফটিকজানি, মির্জাপুরের বংশাই এক সময় ছিল খরস্রোতা। প্রমত্তা এসব নদী দিয়ে মহাজনী নৌকা চলাচল করত।

নদী পাড়ের জেলেসহ অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এসব নদীর অধিকাংশই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেই। ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে নদীর বেশিরভাগ জায়গা। নদী দখল করে কোথাও পাকা ইমারত, কোথাও ইটভাটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘর-বাড়ি, এমনকি আবাদি জমি বানিয়ে রীতিমত ধান চাষ করা হচ্ছে।

এলাসিন এলাকার সেলিম মিয়া বলেন, টাঙ্গাইল জেলা শহর ও নাগরপুর উপজেলায় যেতে আমাদের এই ধলেশ্বরী নদী পার হতে হতো ফেরির মাধ্যমে। এ নদীতে এক সময় বড় বড় লঞ্চ ও নৌকা চলতো। কিন্তু কালের বির্বতনে এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না।

একই এলাকার করিম মিয়া বলেন, এই ধলেশ্বরী নদীতে অনেক স্রোত ছিলো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছুই নেই। ভরা মৌসুম ছাড়া এই নদীতে পানিই পাওয়া যায় না। প্রভাবশালী একটি মহল নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলার কারনে নদী পথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে মূল নদী এখন শুধু বালুর চর।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মাহমুদনগর এলাকার কৃষক রমজান বলেন, আগে এই নদীর পানি আমরা কৃষি কাজে ব্যবহার করতাম। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি থাকলেও শুস্ক মৌসুমে পানি থাকে না। ফলে কৃষি কাজের জন্য পানি আনতে হয় অন্যের সেলু মেশিন ঘর থেকে। একটা সময় ছিলো যখন আমরা এই নদী থেকে পানি নিয়ে কৃষি কাজ করতে পারতাম।

পোড়াবাড়ী ও মাকোড়কোল এলাকায় কথা হয় কয়েকজন জেলের সাথে। তারা জানান, আগে যমুনা, ধলেশ্বরী ও আশপাশের বিভিন্ন খাল-বিলে প্রচুর মাছ ছিলো। কিন্তু এখন আর তেমন একটা মাছ পাই না। ফলে আমাদের অনেকই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় কাজ করে পরিবার চালায়। আগে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও যমুনা নদীতে পানি থাকতো। কিন্তু এখন নদীর মাঝ দিয়ে দুই-তিনটি চর জেগে গেছে। এছাড়াও ধলেশ্বরী নদী ও এর কিছু শাখা নদী ও খাল বিলেও এখন আর তেমন একটা মাছ নেই। যদি পানির প্রবাহ ঠিক থাকতো তাহলে নদী, খাল-বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত।

গোড়িলাবাড়ী ও গোবিন্দাসী এলাকার কয়েকজন বলেন, আগে এই যমুনা নদী পার হতে গিয়ে আমাদের ভয় করতো। এ নদীর যে ডাক ছিলো তা এখন আর শোনা যায় না। এ নদী দিয়ে কত বড় বড় নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা শেষ হয়ে গেছে। আগের যমুনা আর এই সময়ের যমুনা অনেক পার্থক্য। বর্তমানে এ নদীতে তো পানিই থাকে না। নদীর অধিকাংশ এলাকায় এখন চর জেগে রয়েছে।

টাঙ্গাইল শহরের সোহেল রানা বলেন, আমি যখন ছোট তখন এই ধলেশ্বরী নদীর এপার থেকে সাতার দিয়েও ওপাড় যেতে পারতাম না। আর সেই নদী আজ নেই। দখল, ভরাট ও দূষনের ফলে সরু খালের চেয়েও খারাপ অবস্থায় পরিনত হয়েছে নদীটি। আর কয়েক বছর গেলে এখন যা আছে তাও থাকবে না।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, টাঙ্গাইল জেলায় যতগুলো নদ-নদী ও খাল বিল রয়েছে তার অধিকাংশই এখন মৃত। বাকি যেসকল নদ-নদী রয়েছে সেগুলোতে দখল, দূষণ ও অবৈধ ডেজিং-এর কারনে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এতে করে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানে অনেক নদী ও খাল-বিল রয়েছে। বাসযোগ্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী, খাল বিল অপরিসীম ভূমিকা রাখে। ধলেশ্বরী, নিউ ধলেশ্বরী, লৌহজং, এলেংজানি, ঝিনাই নদীতে প্রতিবছর পলি জমে। ওই পলি কেটে নেয়া এবং অপরিকল্পিতভাবে মাটি-বালু উত্তোলনের ফলে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন হয়। তিনি জানান, নিউ ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত অবাধ পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অগ্রাধিকার ভিত্তিক ‘বুড়িগঙ্গা নদী খনন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *