বিশেষ প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কটি রাত হলেই পরিণত হয় ভূতুড়ে এলাকায়। এটি বাসে চলাচলকারী নারী যাত্রীদের জন্য হয়ে উঠেছে আতঙ্কের আরেক নাম। গত ছয় বছরে এই সড়কে চলন্ত বাসে তিন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয় এক নারীকে। এছাড়া সড়কটিতে বাসে প্রতিনিয়ত ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। পর্যাপ্ত পুলিশি টহল ও সড়ক বাতি না থাকায় অপরাধীরা বারবার সড়কটিকেই বেছে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন যাত্রী ও স্থানীয়রা।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল ঢাকা থেকে ধনবাড়ী উপজেলার দত্তবাড়ী গ্রামে খালার বাড়িতে যান এক পোশাক শ্রমিক। পরদিন শুক্রবার ভোরে গাজীপুর যাওয়ার উদ্দেশে বিনিময় পরিবহণের বাসে ওঠেন ওই নারী। বাসে আর কোনো যাত্রী না নিয়ে গেট বন্ধ করে দিয়ে চালক ও তার সহকারীরা মধুপুর বনের কোনো এক নির্জন স্থানে ওই নারীকে ধর্ষণ করে শোলাকুড়ি রাস্তায় ফেলে যায়। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই বাসের চালক নয়ন ও তার দুই সহযোগী রেজাউল ও আব্দুল খালেককে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় করা মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
২০১৭ সালের গত ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে জাকিয়া সুলতানা রূপা নামের এক নারীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে একই সড়কের বন এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়। রূপা একটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী ছিলেন। মধুপুর থানা পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে বেওয়ারিশ হিসাবে টাঙ্গাইল কবরস্থানে দাফন করে। ২৭ আগস্ট নিহতের বড় ভাই পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে লাশের ছবি দেখে বোনকে শনাক্ত করেন।
৩১ আগস্ট লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় ছোঁয়া পরিবহণের চালক হাবিবুর, সহকারী শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীরকে মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানার রায় দেন আদালত। বাসের সুপারভাইজার সফর আলীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন টাঙ্গাইল জেলা আদালত। পাশাপাশি বাসটি রূপার পরিবারকে দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। কিন্তু ৫ বছর ধরে বাসটি মধুপুর থানা প্রাঙ্গণে পড়ে থেকে অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনি জটিলতা ও যথাযথ প্রক্রিয়া না হওয়ায় বাসটি পড়ে আছে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার একই সড়কে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহণের বাসে ডাকাতি ও এক নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। রাতে নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যাত্রী উঠানোর নিয়ম না থাকলেও তিন ধাপে ১১ জন যাত্রীবেশে ডাকাত বাসে ওঠে।
বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপ্লাজা পার হওয়ার পর ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে। এ সময় তারা পুরুষ যাত্রীদের পরনের কাপড় খুলে ও নারী যাত্রীদের জানালার পর্দা দিয়ে হাত, পা, মুখ ও চোখ বেঁধে ফেলে মারধর করে মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুটে নেয়।
ডাকাতরা বাসটি গোড়াই এলাকায় মহাসড়কে ইউটান নিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যেতে থাকে। রাস্তায়ই গাড়ির মধ্যে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে তারা। এ ঘটনায় বাসটির যাত্রী কুষ্টিয়ার হেকমত আলী বাদী হয়ে ১০ জনকে আসামি করে ডাকাতি ও ধর্ষণ মামলা করেছেন। ঘটনার মূলহোতা রাজা মিয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
ময়মনসিংহগামী প্রান্তিক পরিবহণের কয়েকজন যাত্রী বৃহস্পতিবার বিকালে জানান, যেভাবে প্রতিনিয়তই এই সড়কে চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এতে করে তারা আতঙ্কিত। ময়মনসিংহ মোটর মালিক সমিতির নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিটি ঘটনায় জড়িতরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ডাকাতিসহ অপরাধ প্রতিরোধে দেশের মহাসড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ হাইওয়ের অনেকাংশ সিসি ক্যামেরার আওতায় এসেছে। বড় বাসগুলোতে পুশ বাটন স্থাপনের কাজ চলছে। বাসে ডাকাত উঠলে চালক সঙ্গে সঙ্গে পুশ বাটনে চাপ দিলে স্থানীয় পুলিশ তা জানতে পারবে। তিনি আরও বলেন, পুলিশের চেষ্টার পরও কিছু এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত আসামিদের ধরে আইনের আওতায় আনতে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।