মধুপুরে ডাক্তার এন্ড্রিক বেকারের স্মৃতি বিজড়িত গরীবের হাসপাতাল

মধুপুর স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক: গরীবের ডাক্তার খ্যাত এন্ড্রিক বেকার ছিলেন মানবতার এক বড় উদাহরণ। যেখানে বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে আগ্রহী, সেখানে বাংলাদেশে জীবনের বড় একটি অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন এন্ড্রিক বেকার। নিউজিল্যান্ডে জন্ম নেয়া মানুষটি বাংলাদেশে মানবতার সেবায় এসে থেকে যান। টাঙ্গাইলের মধুপুরে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি লাল মাটির এলাকায় গড়ে তোলেছেন কালিয়াকুড়ি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র।

ছায়া ঘেরা সুনির্বিড় গ্রাম্য পল্লী প্রকৃতিতে গড়ে উঠা এ হাসপাতাল প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ বিরজমান। শব্দ দুষণ কোলাহলমুক্ত নির্মল পরিবেশে রোগীরা চিকিৎসা নিতে ভীড় করে থাকে। তার মৃত্যুর পর টিকে আছে ডাক্তার এন্ড্রিক বেকারের নিজ হাতে গড়া হাসপাতালটি। তবে বর্তমানে এর কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দরকার সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা।

জানা যায়, ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী রেলিংটনে জন্ম ডাক্তার এন্ড্রিক বেকারের। তিনি ১৯৬৫ সালে অটাগো ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করে চলে যান যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। পরে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৯৭৮ সালে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালে রেডিও টেলিভিশনে শুনে ছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের কথা। মনের টানে ছুটে এসে টাঙ্গাইলের মধুপুরের পাহাড়িয়া এলাকার চিকিৎসা বঞ্চিত দরিদ্র মানুষ দেখে মন কেঁদে ওঠে তার।

সেখানে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে প্রতিষ্ঠা করেন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। কয়েক বছর সেবা প্রদানের পর সেখান থেকে চলে যান কালিয়াকিড়ি গ্রামে। এক মাটির ঘরে শুরু করে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের নাম দেন কালিয়াকুড়ি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র। স্থানীয়রা তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালকে গরীবের হাসপাতাল বলে থাকে।

টানা ৩৬ বছর চিকিৎসা সেবা প্রদান কালে গড়ে তোলেন নানা স্মৃতি। সখ্যতা গড়ে উঠে গরীব দুঃখি মানুষের সাথে। নিজেকে মানবতার সেবায় বিলিয়ে দেবার অপার বাসনায় সেবা প্রদানের মধ্যে কাটিয়ে দেন। স্থানীয় কয়েক জেলার মানুষেরা সরকারি-বেসরকারি সেবা গ্রহণের পাশাপাশি মাটির হাসপাতালেও সাধারণ সেবা নিতে আসে। এভাবে পাহাড়িয়া পিছিয়ে পড়া এলাকায় স্বাস্থ্য সেবায় দিন দিন এগিয়ে যায়। টানা ৩৬ বছর সেবা প্রদান কালে হাসপাতালেই মারা যান ডা. এন্ড্রিক বেকার। হাসপাতালেই সমাহিত করা হয় তাকে। তার মৃত্যুর পর হাসপাতাল নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন ৯৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারী। ডা. বেকারের নিদের্শনা মোতাবেক হাল ধরেন।

হাসপাতাল চলছে ডাক্তারের স্মৃতি নিয়ে। এলাকার দরিদ্র গরীব রোগীরা যাচ্ছে, পাচ্ছেন চিকিৎসা সেবা। এ চিকিৎসা কেন্দ্রে দূর থেকে আগত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি ভর্তি রেখেও চিকিৎসা করে থাকে।

হাসপাতালের কর্মরত স্টাফ ও রোগীরা জানান, ডাক্তার বেকারের গরীবের হাসপাতালের সেবা পেয়ে খুশি রোগীরা। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী, স্টাফ এলাকাবাসী সব সময় স্মরণ করেন ডাক্তার বেকারকে। তার অভাব পূরণ হবার নয়।

হাসপাতালের ডাক্তার মাইশা মনতাজ বলেন, সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করার পাশাপাশি রোগীদের অবস্থা বুঝে হাসপাতালে ভর্তি রেখে সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।

এ হাসপাতালের তদারককারী নিউজিল্যান্ড চেরিটি কো-অর্ডিনেটর নেদিন ডিকার্স জানান, ছাত্র জীবন থেকেই ডাক্তার এন্ড্রিক বেকারের এ হাসপাতালে তার যাতায়াত। এ হাসপাতালের জন্য নিউজিল্যান্ডে চেরিটি কমিটির কাজ করে থাকে। ছুটি পেলে বাংলাদেশে এসে দেখা শোনা করার পাশাপাশি সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ের কথা জানান।

গরীবের হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক পিজন নংমিন জানান, এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী সেবা নিয়ে থাকে। দূর থেকে আগত রোগীদের ভর্তি রেখেও চিকিৎসা প্রধান করা হয়। চিকিৎসার জন্য বিদেশী দম্পতি এ দুজন ডাক্তার সেবা প্রদান করে। বর্তমানে তারা দেশের বাহিরে রয়েছেন। জুনে চলে আসবেন। হাসপাতালের ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা হয়েছে সবজির বাগান। রোগীর লোকেরা সবাই মিলেমিশে রান্না করে খায়। ডাক্তার এন্ড্রিক বেকারের স্মৃতি নিয়ে চলছে এ হাসপাতাল। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে সেবার মান বৃদ্ধির প্রত্যাশা এ নির্বাহী পরিচালকের।

পাহাড়ি এলাকার মাটির এ হাসপাতালটি চলমান থাকলে দরিদ্র পিছিয়ে পড়া মানুষেরা পাবে স্বাস্থ্য সেবা। চিকিৎসা সেবা অব্যাহত থাকলে গরিবের হাসপাতালটি হয়ে উঠবে অত্র এলাকার স্বাস্থ্য সেবার এক অনন্য নজির স্থাপনকারী কেন্দ্র। এখানে হাজার বছর বেঁচে থাকবেন ডাক্তার এন্ড্রিক বেকার, এমনটাই ধারনা স্থানীয়দের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *