টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ির বুনন শিল্পকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে

ইতিহাস ও ঐতিহ্য জাতীয় টাঙ্গাইল সদর ফিচার

নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ির বুনন শিল্পকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ইউনেস্কো। চলতি বছর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) মানুষের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য এই শিল্পকে মনোনীত করেছে। এমন খবরে টাঙ্গাইল জেলার তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। রবিবার, ৭ ডিসেম্বর বার্তা সংস্থা এপির খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

 

ইউনেস্কোর স্বীকৃতির জন্য আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল তাঁত উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীল কমল বসাক। এ প্রসঙ্গে নীল কমল বসাক বলেন, চারশ’ বছরের ঐতিহ্য এই তাঁত শিল্প। এই মনোনয়ন আমাদের পূর্বপুরুষের শ্রমের স্বীকৃতি। আমরা মনে করি, এই বুনন শিল্প ইউনেস্কোর ঐতিহ্য তালিকায় স্থান করে নেবে।

ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি শাড়ি তৈরি হয় ঐতিহ্য ও কারুশিল্পের সংমিশ্রণে। তাতে থাকে স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত নান্দনিক নকশা ও জটিল ভাব বা সুর। সাধারণত পুরুষরা সুতা রাঙান, কাপড় বুনে নকশা করেন। নারীরা চরকায় সুতা কাটেন।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়, টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ি হলো স্থানীয় তাঁতিদের ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত বুনন কৌশলের চূড়ান্ত রূপ। যদিও শাড়িই এই বুনন কৌশলের সাধারণ এবং ঐতিহ্যবাহী প্রকাশ। সম্প্রতি একই কৌশল ব্যবহার করে আরও নানা ধরনের পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। এই বুনন শিল্পটি মূলত এর নান্দনিক নকশা, স্থানীয়ভাবে তৈরি মোটিফ এবং স্বচ্ছ মসৃণতার জন্য স্বীকৃত ও বিশিষ্ট। টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতিটি অংশ যত্নের সঙ্গে তৈরি একেকটি শিল্পকর্ম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ নামকরণটি টাঙ্গাইল অঞ্চলের নির্দিষ্ট জলবায়ু পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ি শব্দটি কোনো একটি পণ্যের রূপকে বোঝায় না। বরং তাঁতির উৎপাদিত এই ধরনের সব পরিধেয়কে টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়।

এর তাঁতিদের সম্পর্কে বলা হয়, ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি বসাক এবং জোলা সম্প্রদায় বোনে। বসাক সম্প্রদায় হিন্দু, আর জোলা সম্প্রদায় মুসলমান। উভয় সম্প্রদায়ই টাঙ্গাইল শাড়ি তাঁত সমিতির সদস্য।

বুনন কৌশল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় তাঁতিরা জানিয়েছেন, বুনন কৌশল পরিবারের সদস্যদের দেখে অল্প বয়সে শেখা হয়। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণই মূল বিষয়। প্রতিটি বুনন এবং সেলাই একজন তাঁতিকে নিখুঁত করে তোলে। যেহেতু এই শিল্পের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক শেখার পদ্ধতি নেই, তাই প্রতিটি তাঁতির পরিবার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিক কৌশলগুলো হস্তান্তরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এভাবে এই ঐতিহ্যবাহী দক্ষতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরিত হচ্ছে।

এর সামাজিক ভূমিকা এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইল হস্তচালিত তাঁতের শাড়ি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিচিতিকে তুলে ধরে। এটি দুর্গাপূজা, বাংলা নববর্ষ, বিবাহ উৎসব এবং দুই ঈদ উৎসবে পরিধেয় পোশাক।

ইউনেস্কোর এই খবর পাওয়ার পর টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পীরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তাঁতি সম্প্রদায়ের আশা, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেলে এ ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প সংরক্ষণ, বাজার সম্প্রসারণ এবং তরুণদের আগ্রহ বাড়াতে তা বড় ভূমিকা রাখবে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতেও টিকে থাকবে টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য।

টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোফাখখারুল ইসলাম জানান, প্রাচীনকাল থেকেই তাঁতিদের সূক্ষ্ম দক্ষতায় এই শাড়ি তৈরি হচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলা তাঁত শাড়ীর জন্য বিখ্যাত। এই জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, সদর উপজেলার করটিয়া, বাজিতপুর, তারুটিয়া ভাতকুড়া, বাঘিল, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, ছাতিহাটী, রামপুর এলাকাগুলো তাঁত শাড়ি প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকায় বহু বছর ধরেই তাঁত শাড়ি বুনন করে আসছে তাঁতিরা।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক জানান, টাঙ্গাইল শাড়ি ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য কেবল মনোনয়ন পেয়েছে। আশা করা যায় এটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *