বাসাইল প্রতিনিধি: বাসাইলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি অর্থ অপচয় ও আত্মসাতের কারণে কৃষি পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এতে করে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খাদ্য উৎপাদনে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য কৃষকরা প্রতি বছর সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ভোলাসহ দূর দূরান্ত থেকে কম্বাইন হারভেস্টার ভাড়া এনে ধান কাটছেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের এমন অপচয় মেনে নিতে পারছে না ভুক্তভোগীরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থ বছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছর পর্যন্ত মোট ৩৬টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে অর্ধেক ভর্তুকি মূল্যে। অভিযোগ উঠেছে এসব বিতরণের অধিকাংশই ছিল লোক দেখানো ও ফটোসেশন। ফটোসেশন শেষ হলে আবার তা গায়েব হয়ে যেত। হারভেস্টার কোম্পানীর সাথে উপজেলা কৃষি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সরকারের দেয়া অর্ধেক ভর্তুকির টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সরকারের লাখ লাখ টাকার ভর্তুকি কোন কাজে আসেনি। অনেক কৃষক দিনের পর দিন কৃষি অফিসে ধর্ণা দিয়েও বরাদ্দ পায়নি কম্বাইন হারভেস্টার। এ নিয়ে তাদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে।
পৌর এলাকার ৭ নং ওয়ার্ডের আশিক মিয়া বলেন, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আমরা কম্বাইন হারভেস্টারের জন্য উপজেলা কৃষি অফিসে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু আমাদের হারভেস্টার দেয়া হয়নি। অথচ ওই অর্থ বছরে মোট ৮টি মেশিন বরাদ্দ হলে তার তিনটি হারভেস্টারই একই পরিবারে দেয়া হয়েছে। এটা সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই না। আমরা এর বিচার চাই।
একই এলাকার আলহাজ মিয়া বলেন, আমাদের উপজেলা কৃষি অফিসে কম্বাইন হারভেস্টারের জন্য যোগাযোগ করেছি। আমাদের হারভেস্টার না দিয়ে এগুলো কোথায় যায় আমরা জানি না। আমার স্কীমে প্রায় একশ’ বিঘা জমি রয়েছে। আমি কম্বাইন হারভেস্টার আনলাম ভোলা জেলা থেকে ভাড়ার মাধ্যমে। তাকে দিতে হয় প্রতি শতাংশে ৭৫ টাকা। আর কৃষকের কাছ থেকে ৫ টাকা নিয়ে আমাকে ধান কাটতে হয়। আমাদের একটাই প্রশ্ন গাড়িগুলো কোথায় যায়?
২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাসাইল মধ্য পাড়ার কৃষক আরিফুল ইসলাম জামিলের নামে বাংলামার্কের একটি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ দেখানো হয়েছে। ফটোসেশনের জন্য তৎকালীন এমপির মাধ্যমে তার হাতে চাবিও হস্তান্তর করা হয়। এমপি চলে যাওয়ার পর আর তাকে হারভেস্টার বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। তিনি নিজেও জানেন না তার নামে বরাদ্দকৃত সেই হারভেস্টারটি গেল কোথায়। জামিল বলেন, আমার কাছ থেকে সই স্বাক্ষর সব নিয়েছে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর কৃষি অফিস থেকে বলা হয় আমার কম্বাইন হারভেস্টারটি পরে দেয়া হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে তা দেয়া হয়নি। পরে শুনতে পেলাম আমার হারভেস্টারের ভর্তুকির ১৪ লাখ টাকা কোম্পানী ও কৃষি অফিস ভাগ বাটোয়ারা করে খেয়েছে। একই অর্থ বছরে সেলিম রেজা নামের অপর কৃষকের সাথেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাসাইলে মোট ৮টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়। এর তিনটি হারভেস্টারই দেয়া হয় উপজেলার বার্থা গ্রামের মোঃ তালেব সিদ্দিকীর পরিবারে। তালেব সিদ্দিকী ছাড়াও তার দুই ছেলে সৈকত সিদ্দিকী ও মোঃ তানভির সিদ্দিকীর নামে হারভেস্টার বরাদ্দ দেয়া দেয়া হয়। এ বিষয়ে তালেব সিদ্দিকী বলেন, আমার হারভেস্টারটি আছে কালিহাতী উপজেলার কামন্না গ্রামে। আর আমার এক ছেলের হারভেস্টারটি বাড়ি থাকলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাড়িতে পড়ে আছে। আমাদের পরিবারে তিনটি হারভেস্টার বরাদ্দ দেখানো হলেও আমরা পেয়েছি দুইটি। বরাদ্দের অপরটি তারা উৎকোচ হিসেবে নিয়েছেন। পরে অর্ধেক ভর্তুকির টাকা উপজেলা কৃষি অফিস ও কোম্পানীর লোকজন ভাগবাটোয়ারা করে খেয়েছে।
২০২০-২১ অর্থ বছরে বাসাইল উপজেলার বাথুলী সাদী গ্রামের মোঃ খালিদ হোসেন খানের নামের এক ব্যক্তির নামে একটি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আবার একই সেই একই ব্যক্তি নামে আরেকটি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়। সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় কম্বাইন হারভেস্টার দেখতে গেলেও তা সংশ্লিষ্ট গ্রহিতাদের হেফাজতে তা পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শাহজাহান আলী বলেন, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেই কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। সবগুলো কম্বাইন হারভেস্টার সচল আছেন বলেও তিনি জানান।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ আশেক পারভেজ বলেন, আমি টাঙ্গাইলে যোগদানের আগে এসব কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানা নেই।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক অনুষদের ডিন ড. নাজমুস সাদেকীন বলেন, এই অনিয়মের কারণে একটি পক্ষ লাভবান হবে আরেক পক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এসব অপচয় সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। যা দেশের সমগ্র অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উল্লেখ্য, প্রতিটি কম্বাইন হারভেস্টারের দাম প্রায় ২৮ লাখ টাকা। অর্ধেক ভর্তুকির ১৪ লাখ টাকা আত্মসাত করতে উপজেলা কৃষি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা কৃষকদের সরলতাকে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বাসাইল থেকে দ্রুত বদলি হওয়ার চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে এক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বদলি হয়ে চলে গেছেন। এদিকে কিছু কম্বাইন হারভেস্টার এলাকায় থাকলেও তা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।