কালিহাতী প্রতিনিধি: পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদার জোগান দিতে মুড়ি তৈরির কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়ার মুড়ির চাহিদা দেশজুড়ে।
পবিত্র রমজান মাসের ইফতারির রকমারি উপাদানের মধ্যে অত্যাবশকীয় মুড়ির চাহিদা বছর ব্যাপী থাকলেও রোজার সময় উৎপাদন এবং বিক্রি বহুগুণে বেড়ে যায়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় সরবরাহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ গ্রামের কারিগররা। কিন্তু মেশিনে তৈরি মুড়ির দাপটে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি। আধুনিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা মুড়ি।
ইফতারের তালিকায় মুড়িসহ অন্যান্য সময় মুখরোচক খাবার হিসেবে মুড়ির জুড়ি নেই। মুড়ি ব্যবসায়ীরা বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকেন রমজান মাসের জন্য। আবার অনেকে সিজনাল ব্যবসা হিসেবে এ মাসে মুড়ি উৎপাদন এবং বিক্রি করে থাকেন। বর্তমানে এখানকার মুড়ি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীদের কাজের চাপ বাড়লেও আগের তুলনায় এ পেশায় কারিগররা অনত্র অধিক আয়ের কাজে যোগ দিচ্ছেন।
জানা যায়, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মুড়ি সরবরাহ হয়ে থাকে জেলার কালিহাতীর নারান্দিয়া থেকে। এখানকার উৎপাদিত মুড়ির সুনাম দেশের বিভিন্নস্থানে। মুড়ি উৎপাদনের সঙ্গে নারান্দিয়ার মানুষ অনেক পূর্বে থেকেই জড়িত। এখানে দুইভাবে মুড়ি উৎপাদিত হয়, হাতে ভেজে ও মেশিনের সাহায্যে। মুড়ি উৎপাদনকারি এলাকাগুলোর মধ্যে নারান্দিয়া শীর্ষে। নারান্দিয়ার শতাধিক বাড়িতে হাতে ভেজে মুড়ি উৎপাদিত হয়। মেশিনের সাহায্যে মুড়ি উৎপাদন নতুন সংযোজন হলেও হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি এবং বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে শতাধিক পরিবার অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে মোদক সম্প্রদায়।
এছাড়া উপজেলার নারান্দিয়া, মাইস্তা, নগরবাড়ী, দৌলতপুর, লুহুরিয়া ও সিংহটিয়াসহ প্রায় পনেরটি গ্রামের কয়েক’শ পরিবার হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি করে থাকে। একজন ব্যক্তি ১ দিনে এক থেকে দেড় মণ চালের মুড়ি ভাজতে পারেন। প্রতি মণ চালে ২৩ থেকে ২৪ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারি ১৩০ টাকা এবং খুচরা একশ ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মূলত গ্রামের মহিলারাই হাতে ভেজে গুণগত মানসম্মত মুড়ি তৈরি করেন।
মুড়ির কারিগরদের তথ্য মতে, প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ টাকার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন এবং কেনাবেচা হয়। তবে পরিশ্রমের লাভ বেশির ভাগই চলে যায় মধ্যসত্বভোগীদের পকেটে। রমজান মাসে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা পিকআপ, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে বস্তাভর্তি মুড়ি কিনে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকায় বিক্রি করেন। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো থাকায় পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ঢাকা, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও গাজীপুরে,নারান্দিয়ার মুড়ি পাঠানো হয়।
তবে প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা। মেশিনে মুড়ির ভাজতে সময় কম লাগে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি। অন্যদিকে হাতে মুড়ি ভাজতে সময় বেশি লাগে কিন্তু লাভ সামান্য। ফলে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা দিনদিন এ কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় ধাবিত হচ্ছেন এবং অনেকেই চলে গেছেন। এ পেশাকেই টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
দৌলতপুর গ্রামের রাধা রানী মোদক জানান, আমরা বংশ পরম্পরায় এ মুড়ি ভাজা ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি ৩৫ বছর ধরে মুড়ি ভাজি। ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকানোর পর আবার সেই ধান মেশিনে মাড়াই করে মুড়ি ভাজার জন্যে চাল তৈরি করা হয়। পরে সেই চাল দিয়ে লবণ জলের মিশ্রণে আগুনে তাপ সহ্য করে বিশুদ্ধ মুড়ি ভাজতে অনেক পরিশ্রম হয়। সবকিছুর দাম বেশি। পরিশ্রমের তুলনায় তেমনটা লাভ হয় না। মুড়ি ভাজার প্রতি মণ ধান ১,৩০০ টাকা। এক মণ ধানের মুড়ি ভাজতে খড়ি, লবণ, যাতায়াত ও ধান ভাঙানোর খরচ আরো ১৫০ টাকা। সব খরচ বাদে বেশি লাভ হয় না। এক মণ ধানের মুড়ি ভাজলে ৪০০-৫০০ টাকা লাভ হয়। তা দিয়ে চলে না। আমরা সরকারি ভাবে ঋণ সহযোগিতা চাই।
সততা মুড়ির মিলের স্বত্বাধিকারী শংকর চন্দ্র মোদক জানান, রমজানে আমরা অনেক সময় মোবাইলেও মুড়ির অর্ডার নিয়ে সরবারহ করে থাকি। তাছাড়া নির্দিষ্ট বাজারের স্থায়ী ব্যবসায়ীরা মুড়ি ক্রয় করে থাকেন। রমজান ছাড়া বছরের অন্য সময়ে মুড়ির বাজার অর্ধেকে নেমে আসে। শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ও বিপুল সংখ্যক মানুষ পরোক্ষভাবে মুড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে রমজানে কাজের চাপে দম ফেলার সময়টুকু পায় না মুড়ি উৎপাদনকারীরা। তিনি আরও জানান, আমরা প্রতি কেজি মুড়ি ৭০ টাকায় বিক্রি করি। খুচরা ৮০-৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ৫০ কেজি চালের বস্তায় ৪৩-৪৪ কেজি মুড়ি হয়।
এদিকে মেশিনের সাহায্যে বিপুল পরিমান মুড়ি প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হলেও হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেশিনে ভাজা মুড়ি সাদা ও লম্বা করতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ইউরিয়া কিংবা সোডা ব্যবহারের অভিযোগ থাকায় একশ্রেণীর মানুষ বিষমুক্ত হাতেভাজা মুড়ি খেয়ে থাকেন।
কালিহাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান মজনু জানান, আমাদের এলাকাটি মুড়ি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় লাভ কম হওয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। নারান্দিয়ায় মুড়ি কেনাবেচার একটি নির্দিষ্ট বাজার দরকার। এটি এক প্রকার শিল্প। মানুষের চাহিদা পূরণে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকার থেকে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারী ব্যক্তি এবং পরিবারগুলোকে বিশেষ ঋণ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।
কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইল তথা দেশের মধ্যে মুড়ি উৎপাদনের অন্যতম স্থান কালিহাতীর নারান্দিয়া। এখানকার উৎপাদিত লাখ লাখ টাকার মুড়ি সারা দেশে সরবরাহ হচ্ছে। এটি একপ্রকার কুটিরশিল্প। মানুষের চাহিদা পূরণে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে হাতে ভাজা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্যাহ আল মামুন জানান, কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা ও সুনাম রয়েছে। এর সঙ্গে প্রান্তিক মুড়ি তৈরির কারিগরদের অবশ্যই সরকারি সাহায্য করার সুযোগ আছে। তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে কম সুদে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ সহায়তার করার উদ্যোগ নিবো। সেসাথে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানকার হাতে ভাজা মুড়ির ব্র্যান্ডিং ও প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।