ঘাটাইল প্রতিনিধি: ঘাটাইল উপজেলার লোকেরপাড়া ও জামুরিয়া ইউনিয়নের ছয়আনী বকশিয়া গ্রামসহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ ভূমিদস্যু ও মামলাবাজ চক্রের মূলহোতা আতাউর রহমানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। আতাউর রহমান (৬৮) ছয়আনী বকশিয়া গ্রামের মৃত কালু শেখের ছেলে। তিনি এলাকায় 'মামলাবাজ আতোয়ার' নামেই পরিচিত। স্থানীয় সেটেলমেন্ট অফিসে দালালি করায় স্থানীয়রা তাঁকে 'পর্চা আতাউর' নামেও চেনেন। সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানার বাবার নামে নাম হওয়ায় তার প্রভাব খাঁটিয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের গাছগাছালি কৃষিজমি দখল করে নিয়েছেন তিনি। প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা ঠুকে দেন। মামলায় কখনও নিজে আবার কখনও মাদক ব্যবসায়ী ছেলে রনি আবার কখনও বিধবা ভাতিজি জহুরাকে বাদী হিসাবে ব্যবহার করেন। জমিদখল করতে ভাড়াটে সন্ত্রাসী এনে ভাতিজির বাড়িতে আপ্যায়ন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার এসব ভুয়া মামলার ফাঁদে পড়ে চরমভাবে হয়রানি ও ক্ষতির শিকার গরীব ও নিরীহ গ্রামবাসী মুক্তি চেয়েছেন।
সরেজমিনে জানা যায়, এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০টি মামলা করেছেন আতাউর । এসব মামলার বেশিরভাগই 'জমি সংক্রান্ত'। মামলাগুলোতে আসামি করা হয়েছে গ্রামের অর্ধশতাধিক বাসিন্দাকে। স্থানীয় এমনও লোক আছে যার বিরুদ্ধে আতাউর ৭/৮টি মামলা ঠুকেছেন। তার দায়ের করা মিথ্যা মামলার ফাঁদে আটকিয়ে আর্থিক ক্ষতিতে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন।
গত ১৫ অক্টোবর একদল সন্ত্রাসী নিয়ে আতাউর রহমান ছয়আনী বকশিয়া গ্রামের সাবেক অধ্যাপক ও ছড়াকার শাজু রহমানের জমি দখল করতে যান। আতাউর তাঁর কাঁটাতারের বেড়া, একটি পানির মোটর ও ৩০টি সিমেন্টের খুঁটিসহ প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় বাধা দিলে শাজু রহমানের স্ত্রী আমিনা খাতুনকে মারধর করে এবং দায়ের কোপে বা হাতের কব্জি কেটে ফেলেন। আহত অবস্থায় আমিনাকে উদ্ধার করে ঘাটাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভার্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে ১৮ অক্টোবর আমিনা খাতুন ৰাদী হয়ে ঘাটাইল থানায় এজাহার দায়ের করেন (মামলা নং ১০/২৪)। এজহারে আতাউর রহমান (৬৬), ছেলে মো: রনি (৩২), মো. রোমান (২৫) ও একই গ্রামের মৃত রফেতুল্লাহ মণ্ডলের ছেলে চান মিয়াসহ (৫০) অজ্ঞাত আরও ১০/১২ জনকে আসামী করা হয়। বর্তমানে আসামীরা পলাতক রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামবাসীর পাশাপাশি নিজের আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিরাও রক্ষা পায়নি আতাউরের মামলার হাত থেকে। আতাউরের দায়ের করা মামলায় জর্জড়িত ছিলেন একই গ্রামের আব্দুল হামিদ ও শামিমের পরিবার। মামলা ও হামলার কারণে প্রায় ১৫ বছর যাবত মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন শামীম। নিজের জমি অবৈধভাবে দখল করে উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে আজিজুর রহমান, আনছের আলী, খাদিজা বেগম, শাহনাজ পারভীন, খোদেজা খাতুন, মীমসহ অসংখ্য পরিবারকে হয়রানি করে নিঃস্ব করেছেন আতাউর রহমান।
তারা আরোও জানান, আর এজন্য স্থানীয়রা আতাউর রহমানকে 'মামলাবাজ আতাউর' নামে ডেকে থাকে। ২০২০ সালের ৭ জুলাই উপজেলার জামুরিয়া ইউনিয়নের গালা পশ্চিমপাড়া গ্রামে নদীর পারের জমি দখলে নিতে ঢোল বাজিয়ে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুল হামিদের বসতঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল আতাউর। বাড়ির লোকজনকে অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দিয়ে ঢোল বাজিয়ে বসতঘর গুঁড়িয়ে লুটপাট করে নিয়ে যায়।
গালা গ্রামের ভুক্তভোগী আব্দুল হামিদ জানান, তার জায়গা জমি দখলের উদ্দেশ্যে আতাউর তার নামে তিনটি মামলা দায়ের করে চরমভাবে হয়রানি করছেন। আতাউরের দায়ের করা মিথ্যা মামলার কারণে মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে তিনি চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, ২০১২ সালে আতাউর তার বিধবা ভাতিজি জহুরাকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলায় করিয়েছিল। এরপর কবর ভাঙার মামলাও দেয়। এতেও সুবিধা করতে না পেরে পরবর্তীতে জাল-জালিয়াতির আরও একটি মামলা করেন তার বিরুদ্ধে। এসব মামলায় তিনিসহ পরিবারের সদস্যদেরও আসামি করা হয়।
শাহনাজ পারভীন নামে স্থানীয় এক নারী জানান, তার স্বামীর পৈত্রিক সম্পত্তি জোর করে দখল করে নিয়ে উল্টো তার স্বামীর মাথায় দা দিয়ে কোপ দেয়। প্রায় দুই মাস ময়মনসিংহ হাসপাতালে চিকিৎসা করেও স্বামীকে সুস্থ করতে পারেননি। তার স্বামী এখন মানসিক প্রতিবন্ধী। এ অবস্থায় শাহনাজ সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহাদৎ হোসেন জানান, শাজু রহমানের সাথে জমি নিয়ে বিরোধের মীমাংসায় একটি সালিশি বৈঠকে বসেছিলাম, সেখানে উপস্থিত অনেকেই জানিয়েছেন, 'আতাউর ভূমিদস্যু ও মামলাবাজ। কিন্তু সালিশে আতাউর উপস্থিত হয়নি।'
ভূক্তভোগী গ্রামবাসী জানায়, আতাউর রহমান একজন মামলাবাজ ভূমিদস্যু ও কুটিল প্রকৃতির লোক। সে বিভিন্ন লোকের বিরুদ্ধে ২৮/৩০ টি মামলা করেছে। সর্বশেষ শাজু রহমানের ৯৯ শতাংশ জমি দখলের উদ্দেশ্যে হামলা চালায় আতাউর। এসময় শাজু রহমানের আত্মীয়রা এগিয়ে এসে দখলে বাধা দিতে আসলে তাদের মারধর করে হামলাকারীরা। হামলায় কয়েকজন গুরুতর আহত হন। পরে গ্রামবাসী এগিয়ে আসলে আতাউর দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়। এসব বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তদন্ত করে প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে অভিযোগ এজহারভুক্ত করেছেন।
সাবেক অধ্যাপক ও ছড়াকার শাজু রহমান বলেন, আতাউর রহমান একজন পেশাদার ভূমিদস্যু, ভূমি দখলে কেউ বাধা দিলেই হামলা ও মামলা করেন। সাবেক এমপির নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ সে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। হামলা-মামলায় তার মাদক ব্যবসায়ী রনি ও ভাতিজিকে ব্যবহার করেন। সাধারণ মানুষ আগে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পেত না; এখন তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে আতাউর রহমান বলেন, আমি অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছি এটা সত্য। কারণ তারা আমাদের জায়গা জমি দখল করে রেখেছে। তাদের দখল থেকে উদ্ধারের জন্য এসব মামলা করা হয়েছে। ভাতিজিকে দিয়ে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়েরের বিরুদ্ধে তিনি বলেন, ঘটনা সত্য। সে জহুরাকে ধর্ষণ করেছিল। যে অপরাধ করবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার তার আছে।
১৫ অক্টোবর হামলার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, সেদিন আমি বা আমার লোকজন কারও ওপর হামলা করেনি। যারা এসব বলছে তারাই উল্টো হামলা করেছে। এ ঘটনায় তারা থানায় অভিযোগ দিয়েছে, আমি আদালতে মামলা দিয়েছি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘাটাইল থানার পুলিশের উপ-পরিদর্শক রাজু আহমেদ বলেন, ঘটনার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। আসামীরা পলাতক রয়েছেন। তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।