ঘাটাইল প্রতিনিধি: জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে আরিফ পিঠে পুলিশের বুলেটে গুরুতর আহত হয়ে এখনো শয্যাশায়ী। এক রকম স্থবির জীবন-যাপন এখন তার। আরিফের স্বপ্ন লেখাপড়া করে একজন ভালো মানুষ হওয়া, একটা ভালো চাকুরির মাধ্যমে দেশ সেবাসহ নিজের অস্বচ্ছল পরিবারকে সচ্ছল করা আর পূরণ হচ্ছে না। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের চালানো বুলেটে আরিফের স্বপ্নকে ভেঙে দিলেও তার পরিবারের পাশে আজ কেউ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরিফ ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামের মৃত আবুল কাশেম ও আন্না খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে। ধলাপাড়া কলেজ থেকে গত এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ (৪.০৮) পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে তার দরিদ্র পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। এখন তার অবস্থায় পরিবার বেকায়দায় পড়েছে। নিজের চিকিৎসা ও সংসারের খরচের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারা না পারা এখন অদৃষ্ট। ফলে এক অনিশ্চয়তার দোলাচালে পড়েছে আরিফের পরিবার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয়ার পর পুলিশের ছোঁড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয় তার। বুলেট বুকের পাঁজর ভেদ করে বাম হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। খাদ্যনালীও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। সেদিন আরিফ ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ দিন চিকিৎসা শেষ করে এখন বাড়ি ফিরেছে। খাবার খাওয়ার পরেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় তাকে। এ ব্যথা প্রায় দুইঘন্টা স্থায়ী হয়। এখনও তিনি শঙ্কা মুক্ত নন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি টিনের ঘরে আরিফের পরিবারের বসবাস। সাংবাদিক এসেছে শুনে তিনি খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যদিও পুরো মুখে ছড়িয়ে রয়েছে বিষণ্নতার ছাপ। এদিকে মুর্হুুতের মধ্যে এলাকার লোকজন তার বাড়িতে এসে ভীড় জমাতে শুরু করে। আরিফের বাবার মৃত্যুর পর তার মা অসুস্থ থাকার কারণে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে। বিবাহিত জীবনে আরিফের স্ত্রীসহ দেড়মাসের একটি ফুটফুটে সন্তান রয়েছে।
আন্দোলনের ঘটনার বর্ণনায় আরিফ হোসেন বলেন, শুরু থেকেই আমি ঘাটাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই। ১৯ জুলাই চাচাতো ভাই রায়হান সিঙ্গাপুর চলে যাবে বিধায় তাকে নিয়ে ঢাকায় এয়ারপোর্টে পোঁছে দেই। এরপর ঢাকায় থেকে যাই। পরের দিন বন্ধুদের সাথে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেই। সেদিন আমরা বিভিন্ন স্কুূল-কলেজের প্রায় ৬০ ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। আমরা যখন মিছিল শুরু করি তখন হঠাৎ পুলিশের তিনটি গাড়ি আসে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে।আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি আমার পিঠে বিদ্ধ হয়ে বুকের পাঁজর ভেদ করে হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এরপর আমি আর কিছুই জানি না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ ৫০ দিন চিকিৎসা শেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফিরি। এখন বাড়ি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, আরো তিন বছর চিকিৎসা করাতে হবে। আমি ১৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি খরচে চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছি। সংসারের খরচ বহন করে পরিবারের পক্ষে আমার চিকিৎসা খরচ আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরিফের মা আন্না খাতুন (৫০) জানান, গত ২০ জুলাই ঢাকার উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বন্ধুদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে আরিফ পুলিশের ছোঁড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাকে সহপাঠীরা উদ্ধার করে প্রাথমিক অবস্থায় ১৩ নম্বরে উত্তরা স্পেশালিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রথম দফায় অপারেশন শেষে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে পরের দিন আরিফকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন ডাক্তারা জানায়, গুলি লাগার কারণে আরিফের ফুসফুসের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। আবার জটিলতা বাড়ার ফলে তৃতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ও আর বাঁচবে না। সকলের দোয়ায় আল্লাহ ওকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ জন্য আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।
তিনি আরও জানান, ঢাকায় চিকিৎসার সময়ে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ খরচ আমার পরিবারের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্য করতে হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ করার দুঃশ্চিন্তা আরিফকে আরো রোগা করে তুলছে। তারপর আরিফের চিকিৎসা, ঔষধপত্র কেনা, সংসারের খরচ বহন করে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বড় ছেলে আল-আমিনকে ঋণ করে সাত বছর আগে বিদেশে পাঠিয়েছি ভাগ্য বদলের আশায়। সেখানে গিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারেনি ও। এখনও ঋণের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এখন প্রতি মাসে যা টাকা দেয় তাতে আমাদের সংসার চলে না। আমাদের কোন আবাদি জমি নেই, সবই কিনে খেতে হয়। আরিফ সুস্থ হলে তিনি তার ছেলের জন্য সরকারের কাছে একটা চাকুরির দাবি করেছেন।
আরিফের স্বজন শাহ আলম জানান, আরিফ এলাকায় খুবই বিনয়ী ও পরোপকারী বলে পরিচিত। বর্তমানে কর্মক্ষমতা হারিয়ে আরিফের পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে। বাবার মৃত্যুর পর ওর মা দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল। ওর মায়ের দেখাশুনা ও সংসারের কথা ভেবে ২০২২ সালে এসএসসি পাস করার পর আরিফকে বিয়ে করতে হয়। তার ঘরে একটি মেয়ে রয়েছে। তাদের খরচ ও চালাতে হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকার অনুদান ছাড়া ওরা আর কিছুই পায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাটাইলের অন্যতম সমন্বয়ক রাকিবুল হাসান রাকিব জানান, আরিফের চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে এখন আরো অর্থের প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষে এ অর্থের যোগান দেয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমরা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আরিফের বিষয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত তাহলে আরিফকে সুস্থ করতে অনেক সহজ হতো। স্বপ্ন পূরণের পথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে পারতো।
জেলা প্রশাসক শরিফা হক জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে সব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের সামান্য কিছু সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া সরকারিভাবে ঘোষণা আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে।