নিজস্ব প্রতিবেদক: আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে জেলার ১২টি উপজেলার ২৪১টি স্থায়ী ও দেড় শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাট জমে উঠেছে। হাটে বিক্রির জন্য এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এটা গত বছরের চেয়ে ২১ হাজার ৫১৬টি বেশি। এরপরও হাটগুলোতে পশুর দাম আকাশচুম্বি। ৬-৭ মণ ওজনের একটি ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড়ের দাম হাকা হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। ৪-৫ মণ ওজনের ষাড় গরুর দাম হাকা হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে লালন-পালনকৃত দেশি জাতের গরুর দাম আরও বেশি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ছোট পশুর চেয়ে বড় পশুর দাম তুলনামূলকভাবে কম। ৪-৫ মণ ওজনের গরুর দাম সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সাধারণ শ্রেণির ক্রেতারা এককভাবে কোরবানির গরু কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে ২ থেকে ৭ জন মিলে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গরু কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। একই রকমভাবে মহিষ, ছাগল ও ভেড়াও হাটগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া পশুর হাটগুলোতে একটি মাঝারি সাইজের গরুর জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা এবং ক্রেতার কাছ থেকে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা খাজনা (টোল) রাখা হচ্ছে। একটি মাঝারি সাইজের ষাড় কেনার পর ক্রেতার কাছ থেকে ১-২ হাজার টাকা খাজনা গত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাছাড়া সরকারি হাটগুলোতে শুধুমাত্র ক্রেতাই খাজনা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু বিক্রেতাদের কাছ থেকেও খাজনা (টোল) নেওয়া হচ্ছে। ফলে বিক্রেতারা এক প্রকার বিরম্বনায় পড়ছেন।
জেলার সবচেয়ে বড় ষাড় ৫২ মণ ওজনের দেলদুয়ার উপজেলার কলেজছাত্রী হামিদা আক্তারের মানিকের দাম হাকা হচ্ছে ১৬ লাখ টাকা। গত বছর এ ষাড়টির ওজন ছিল ৪৫ মণ আর দাম চাওয়া হয় ১৫ লাখ টাকা। ঢাকার গাবতলী হাটেও উঠিয়েছিলেন কিন্তু বিক্রি হয়নি। ষাড়টি নিয়ে হামিদা আক্তার এক প্রকার বিপাকেই পড়েছেন। গত বছর বিক্রি না হওয়ায় তিনি এবার কিছুটা কম দামে হলেও ষাড়টি বিক্রি করতে চান।
পশু বিক্রেতারা জানান, কোরবানির পশুর দাম গত বছরের তুলনায় বাড়েনি। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার সাথে তুলনা করলে পশুর দাম মোটেই বাড়েনি। গরু লালন-পালন ছাড়াও হাটে ওঠাতে গরুর পেছনে বাড়তি খরচ আছে। তাছাড়া বিক্রি করলেও হাটের খাজনা পরিশোধ করতে হয়। এখন পশু লালন-পালনে ভূষি, নালি, খৈল, চালের গুড়া, খড়, কাঁচা ঘাষ ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। যার মূল্য আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিক কারণে এবার কোরবানির পশুর দামও বেড়েছে বলা হচ্ছে- এটা ঠিক নয়।
অপরদিকে কোরবানির পশু ক্রেতারা জানান, বিক্রেতারা কোরবানির পশুর দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে চাচ্ছেন। গত বছর যে গরু ৮০-৯০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত এবার তার দাম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বলছেন। তবে বড় গরুর দাম তুলনামূলকভাবে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকা ৪-৬ মণ ওজনের একটি গরুর দাম হাকা হচ্ছে সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে তারা অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে গরু কোরবানি দেওয়ার কথা ভাবছেন।
গোবিন্দাসী গরুর হাটে খাজনা (টোল) আদায়কারীরা জানায়, তারা নিয়মানুযায়ী খাজনা আদায় করছেন। কোনভাবেই অতিরিক্ত খাজনা (টোল) নিচ্ছেন না। কোরবানির গরুতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই খাজনা দিয়ে থাকেন- এটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় সরকারি অর্থাৎ স্থায়ী হাট রয়েছে ২৪১টি। কোরবানি উপলক্ষে জেলায় দেড় শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হচ্ছে। এরমধ্যে ভূঞাপুরের স্থায়ী ৯টি হাটের মধ্যে গোবিন্দাসী গরুর হাটটি সবচেয়ে বড়। ৯০ দশকে এটা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। নানা কারণে ওই হাট এখন জৌলুস হারিয়েছে। দীর্ঘ চার বছর ধরে সরকারিভাবে খাস কালেকশন করা হচ্ছে। এছাড়া মাটিকাটা, শিয়ালকোল, সারপলশিয়া, অজুর্ণা, সিরাজকান্দি, নিকরাইল ইত্যাদি হাটগুলো প্রসিদ্ধ।
সদর উপজেলায় ২৩টি হাটের মধ্যে বেবিস্ট্যান্ড, অয়নাপুর, যুগনী, রসুলপুর, চারাবাড়ী, করটিয়া ইত্যাদি হাটগুলো পশু বেচা-কেনার জন্য অন্যতম। কালিহাতীর ২৫টি স্থায়ী হাটের মধ্যে এলেঙ্গা, মগড়া, আউলিয়াবাদ, মরিচা, বল্লা, রামপুর, পৌজান প্রভৃতি। ঘাটাইলে ১১টি হাটের মধ্যে কদমতলী, হামিদপুর, পাকুটিয়া, ব্রাক্ষ্মণশাসন, ধলাপাড়া প্রভৃতি। মধুপুরের ১৮টি হাটের মধ্যে কাকরাইদ, শোলাকুড়ি, চাপড়ী, গাংগাইর, বানরগাছি প্রভৃতি; ধনবাড়ীর ১১টি হাটের মধ্যে মুশুদ্দি, পাইস্কা, কদমতলী, কেরামজানী প্রভৃতি; দেলদুয়ারের ১৫টি হাটের মধ্যে দেলদুয়ার, নাল্লাপাড়া, লাউহাটি, রূপসী, ফাজিলহাটী প্রভৃতি। নাগরপুরের ১৮টি হাটের মধ্যে তেবাড়িয়া চাঁদগঞ্জ, সলিমাবাদ, শাহজানী, গয়হাটা প্রভৃতি। মির্জাপুরের ৩৬টি হাটের মধ্যে দেওহাটা, ফতেপুর, জামুর্কী, মির্জাপুর ইত্যাদি প্রসিদ্ধ পশুরহাট হিসেবে পরিচিত। এছাড়া মির্জাপুর উপজেলায় ১১২টি দৈনিক বাজার রয়েছে- সেগুলোর কয়েকটিতে অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সখীপুরের ৩৮টি হাটের মধ্যে দাঁড়িয়াপুরের ছিলিমপুর, কালিদাস, কচুয়া, বড় চওনা, কাইতলা, তক্তারচালা, বহেড়াতৈল, নাকশালা প্রভৃতি। এরমধ্যে কাইতলা পশুর হাটে খাজনা কম নেওয়ায় বর্তমান সময়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। বাসাইলের ১৮টি স্থায়ী হাটের মধ্যে বাসাইল, কাশিল বটতলা, মৈশাখালী, কাউলজানী, হাবলা, আইসড়া প্রভৃতি এবং গোপালপুর উপজেলার স্থায়ী ১৮টি হাটের মধ্যে নলীন, ভেঙ্গুলা, গোপালপুর, মির্জাপুর, আলমনগর হাটগুলো পশু বেচা-কেনার জন্য প্রসিদ্ধ।
এদিকে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ, কেনা-বেচা ও পরিবহণ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কোরবানির চামড়া পশুর শরীর থেকে ছাড়াতে সতর্কতার সাথে বৈধ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে এছাড়া কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬৭ হাজার ৬২০টি গরু, ৩১৭টি মহিষ, এক লাখ ২০ হাজার ১৫৮টি ছাগল এবং ৩ হাজার ৮৪৬টি ভেড়া রয়েছে। গত বছর এক লাখ ৭০ হাজার ৪২৭টি পশু জেলায় কোরবানি করা হয়েছে। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় এ বছর দেড় লাখের অধিক পশু কোরবানি হবে বলে ধারণা করছে। তারপরও গত বছরের তুলনায় এবার ২১ হাজার ৫১৬টি বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন খামারে কোরবানির পশু মোটা-তাজা করা হয়েছে। কোন কোন খামারী বস, বাংলার বস, মানিক, কালা মানিক ইত্যাদি নামে বড় জাতের (ফ্রিজিয়ান) গরু লালন-পালন করে জেলাসহ দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন।
জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মোঃ রানা মিয়া জানান, গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় প্রায় ২৫ হাজার বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রায় তিন হাজার খামারী গরুর হাট ছাড়াও অনলাইনে বিক্রি করছেন। প্রায় খামারীই গরুর অনলাইন ভিত্তিক পেইজ খুলে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছেন। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়েরও একটি পেইজ রয়েছে। ক্রেতারা সেখান থেকেও পছন্দের পশুটি কিনতে পারছেন।
পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানান, যে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মহাসড়কসহ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে গরু পরিবহনের ট্রাকগুলোকে পুলিশের বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি প্রতিরোধে জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে। জেলার গরুর হাটগুলোতে পুলিশের টহল টিম সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জেলা পুলিশ নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে।