আনারসের রাজধানী মধুপুর

আনারসের রাজধানী মধুপুর: কেন্দ্রবিন্দু জলছত্র বাজার

কৃষি জাতীয় টাঙ্গাইল ফিচার মধুপুর

সময়তরঙ্গ ডেক্স: পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় সুমিষ্ট ফল আনারসের দেশের ঠিকানা হচ্ছে মধুপুরে আর এর কেন্দ্রবিন্দু জলছত্রে। এখানে গড়ে উঠা আনারসের রাজ্যের নানা রকম ঐতিহ্য ও গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে।

 

মধুপুরে জায়ান্টকিই জাতের আনারসের চাষই সবচেয়ে বেশি হয়। এ বছর মধুপুরে ৬ হাজার ৫৭১ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে জায়ান্টকিউ ও ১৯০ হেক্টর জমিতে হানিকুইন জাতের আনারস চাষ হয়েছে।

 

আনারস খুবই রসালো এবং সুস্বাদু ফল। পুষ্টি-গুণে সমৃদ্ধ বিশেষ উপকারী এই ফল। আনারস এক প্রকারের গুচ্ছফল। এর অন্যান্য নাম – Pineapple, Anannas, Ananus, Bahunetraphalam, Anamnasam । এর বৈজ্ঞানিক নাম: Ananas comosus (L.) Merr. আনারসের আদি জন্মস্থল দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ। বর্তমানে ক্রান্তীয় অঞ্চলে বিশ্বের সর্বত্রই এর চাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। কোস্টারিকা, ব্রাজিল এবং ফিলিপাইন এই তিনটি দেশ একত্রে বিশ্বের সমগ্র আনারস উৎপদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন করলেও বাংলাদেশ এক বিশেষ অবস্থানে রয়েছে।

 

পুষ্টিকর ফলের বেশ বড় একটি উৎস আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস। এসব উপাদান আমাদের দেহের পুষ্টির অভাব পূরণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে, হাড় গঠনে, দাত ও মাড়ি সুরক্ষা করে, চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে, হজম শক্তি বাড়ায় এবং রক্ত জমাট বাধায় সাহায্য করে।

 

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলাতে আনারসের চাষ হলেও টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারসের সুনাম দেশজুড়ে। মধুপুরের অরুনখোলা, আউশনাড়া, ষোলাকুড়ি ইউনিয়নে আনারসের ব্যাপক চাষ হয়। এই এলাকায় উৎপাদিত আনারসের মধ্যে জনপ্রিয় জলডুগি আনারস। এছাড়া বর্তমানে জায়ান্টকিউ আনারস চাষের দিকে কৃষকরা ঝুকছেন। প্রতিবছর বর্ষাকালে, এমনকি সারাবছর দেশের বাজারে বড় বড় সাইজের যে আনারস দেখা যায় তার অধিকাংশই মধুপুর এলাকায় উৎপন্ন হয়।

 

জেলার মধুপুর উপজেলায় জলছত্র নামক বাজারে সপ্তাহে দুইদিন আনারসের হাট বসে। প্রতি শুক্রবার এবং মঙ্গলবার দিন। আশেপাশের এলাকার চাষীরা নিজেদের জমিতে উৎপাদিত আনারস বিক্রির উদ্দেশ্যে হাটে এসে উপস্থিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন। ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় ক্রেতা বিক্রেতার সরব উপস্থিতি।

আনারস বিক্রেতারা আসেন নিকটবর্তী নানাগ্রাম থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে, সাইকেলে করে, ভ্যান বা রিক্সায় করে, পিকআপে ভর্তি করে আনারস নিয়ে। গাছপাকা আনারসে উপচে পরে বাহন আর কৃষকের মুখভর্তি থাকে নির্মল হাসি; আনারসের সাথেই গেথে থাকে আগামী নতুন দিনের স্বপ্ন। জলছত্রের টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কেই বসে আনারস কেনাবেচার এই উৎসব। হাট চলাকালীন সময়ে ২৫ মাইলের মোড় থেকে পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত হয়।

হাটের যে দিকে চোখ যায় আনারস আর আনারস, চারদিকে রাস্তার পাশে দোকানের কাছে স্তুপ আকারে রাখা আনারস। কৃষক সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছে পরম মমতায়, বছর ধরে যত্ন করে ফলানো আনারস। বড় বড় ট্রাকে-পিক আপ ভর্তি করা হচ্ছে আনারসে। আনারস ঘিরে এরকম বিশাল কর্মযজ্ঞ চলতে পারে এখানে না আসলে এবং স্বচক্ষে না দেখলে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আনারস পাকার মৌসুম শুরু হয়ে সারাবছর জলছত্রে আনারসের বাজার লেগে থাকে। গারো বাজার, মধুপুর বাজার, ২৫ মাইল বাজারে আনারসের বেচেকেনা হলেও জলছত্র বাজারেই হয় সবচেয়ে বড় হাট। এখানে থেকে যে কেউ আনাস কিনতেও পারেন তবে এক দুই পিস কিনতে চাইলে সরাসরি কৃষকদের থেকে পারবেন না। পাশেই খুচরা বিক্রেতা আছে তাদের থেকে নিতে হবে। এছাড়াও এই বাজারে কৃষষের উৎপাদিত কলা, কামরাঙ্গা, আমড়া, কচুর বেচাকেনাও হয়।

বাজার দেখা শেষ করে রিক্সা ভ্যানে উঠে চলে যেতে পারেন আনারসের ক্ষেত দেখার জন্য; শালবন পেরিয়ে নিকটবর্তী কোনো এক গ্রামে। আসা যাওয়ার পথে সাইকেলের দুইপাশে আনারস ঝুলিয়ে নিয়ে আসার চমৎকার দৃশ্য চোখে পরবে। যেতে পারেন নিকটবর্তী শান্তিনগর গ্রামে, ভ্যান থেকে বটতলা বাজারে নেমে সামনের দিকে কিছুদূর যাওয়ার পরেই শুরু। গ্রাম্য মাটির রাস্তার দুইপাশে অজস্র আনারস বাগানের দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ আর সারি সারি সাজানো আনারস। কোনো গাছে গোলাপী মুকুল ধরেছে কোনোটাতে লালচে ফুল আবার কোনোটাতে সদ্য প্রস্ফুটিত রসালো ফল। তবে আনারস গাছে কাটা থাকায় বাগানের পাশ দিয়ে চলাচলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

এই এলাকার প্রধান চাষাবাদ আনারস হলে সাথে অনেকেই কলা বা কচুর চাষ করেন। আনারস বাগানে প্রবেশ অবশ্যই কৃষকের সাথে কথা বলে অনুমতি নিয়ে বাগানে প্রবেশ করবেন। সকল কৃষক খুবই আন্তরিক, আপনাকে নিজ হাতে আনারস কেটে এনে দিবেন এবং দুপুরে ভাত না খাওয়ার প্রস্তাবও দিবেন। আশাকরি কেউ গেলে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে বাগানে প্রবেশ করবেন।

জলছত্র যাতায়াত: ঢাকা থেকে মধুপুরে যাতায়াতের জন্য সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে। মহাখালী থেকে বিনিময়, শুভেচ্ছা কিংবা জামালপুরগামী বাসে মধুপুর নামতে পারবেন। ভাড়া নিবে ১৮০-২৫০ টাকা। কল্যাণপুর থেকে সোনিয়া, বিনিময় পরিবহনের এসি বাসও আছে ধনবাড়ি পর্যন্ত ভাড়া ৪০০ টাকা। মধুপুর নেমে অটোরিকশা বা ভ্যানে করে আসতে হবে জলছত্র।

এছাড়া ঢাকা থেকে এনা, শৌখিন, ইসলাম কিংবা রাজীব বাসে অথবা ট্রেনে ময়মনসিংহ এসে টাঙ্গাইলের প্রান্তিক সুপার বাসে অথবা উত্তরাঞ্চলের যে কোনো বাসে মধুপুর আসা যাবে। ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি আসলে জলছত্র বাজারেই নামা যাবে।

আবাসন: ঢাকা থেকে ভোরে রওনা করলে জলছত্রের আনারস বাজার দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায়। আপনি চাইলে এখানে রয়েছে থাকার জন্য আবাসিক ব্যাবস্থা। মধুপুরে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। হোটেল সৈকত, হোটেল আদিত্য, হোটেল ড্রিম টাচ ভাড়া পরবে ২০০-১০০০ টাকা। ভালোমানের থাকার ব্যাবস্থা সাথে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে স্বল্প দূরত্বে রয়েছে পার্শ্ববর্তী উপজেলা ধানবাড়ির নবাব প্যালেস ও নবার বাড়ীর মসজিদ পরিদর্শনও করতে পারেন।

এছাড়া পূর্বানুমতি নিয়ে বনবিভাগের কোনো বিশ্রামাগারে থাকতে পারলে আপনার ভ্রমণ পরিপূর্ণ হবে। মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ভেতরে জলই, মহুয়া, বকুল, চুনিয়া কটেজ ছাড়াও দোখলা বন বিশ্রামাগারে রাতযাপন করতে সহকারী বন সংরক্ষক (উত্তর- ০১৯১৪-৫১৭২৫৬) অথবা টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কার্যালয় (০৯২১-৬৩৫২৪) থেকে অনুমতি নিয়ে বুকিং নিশ্চিত করতে হবে।

খাবার দাবার: জলছত্র বাজার কিংবা মধুপুর দুই জায়গাতেই পাবেন নানামানের হরেক খাবারের হোটেল। মোটামুটিমানের হোটেল আছে। দুপুরের খাবার পেয়ে যাবেন ১২০-২০০ টাকার মধ্যে। এটি একটি গ্রাম্য বাজার তাই ভ্রমণকালে স্থানীয়দের সম্মান করাসহ সকল স্থানীয় রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। পরিবেশ সুন্দর রাখতে নিজেদের ব্যবহৃত অপচনশীল দ্রব্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহামুদুল হাসান বলেন, এই বছর মধুপুরে আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে। রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধে কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজারসহ আমি নিজেও তত্ত্বাবধান করেছি। তিনি বলেন, চলতি অর্থ বছর থেকেই অর্গানিক পদ্বতিতে উৎপাদিত মধুপুরের এই আনারস ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে হটেক্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে রফতানি করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *