নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম-যন্ত্রপাতি সবই আছে। নোংরা পরিবেশসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্সসহ লোকবল নিয়োগ না হওয়ায় স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না মানুষ। এছাড়া অযত্নে-অবহেলায় সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা ও কেনা যন্ত্রপাতিও নষ্ট হচ্ছে। এ নিয়ে জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে পুরোপুরি চিকিৎসা সেবা চালুর দাবি জানিয়েছেন টাঙ্গাইলবাসী।
জানা যায়, টাঙ্গাইলবাসীর প্রায় ৪০ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবায় দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের। অবশেষে ২০১৪ সালে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ক্যাম্পাসে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। হাসপাতালের ১৫ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ করে গণপূর্ত বিভাগ ২০২২ সালের ২২ মার্চে হাসপাতাল ভবনটি কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয়। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জামও কেনা হয়েছে। জেলাবাসীর উন্নত চিকিৎসাসেবায় যা একটি মাইলফলক হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নিলেও শুরুতেই যেন হোঁচট খেতে শুরু করেছে এ হাসপাতালটি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নতুন ১৫ তালা ভবন নির্মাণের পর থেকে তা চিকিৎসাসেবার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। এরই মধ্যে অন্তবিভাগ মেডিসিন ওর্য়াড ও বর্হিবিভাগ চালু করা হয়েছে। গত বছরের ২১ জুন বহির্বিভাগে মেডিসিন, শিশু, গাইনি, সার্জারি, চক্ষু, ডেন্টাল, বক্ষব্যাধি, নিউরোলজি, ইউরোলজি, মানসিক, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, ফিজিকাল মেডিসিন, চর্ম ও যৌন, কার্ডিওলজি, নেফরোলজি, অর্থোপেডিক, অনকোলজি (ক্যানসার) সেবা চালু হয়। এছাড়া আলট্রাসনো, ইসিজি, সিটিস্ক্যান, এক্সরেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এছাড়া গত বছর সেপ্টেম্বরে আন্তঃবিভাগে মেডিসিন বিভাগ চালু হয়। চক্ষু, নাক-কান-গলা, গাইনি, কার্ডিওলজি, অবস (গর্ভবতী), অর্থোপেডিক, পোস্ট অপারেটিভ, আইসিইউ, সিসিইউ, সার্জারি ওয়ার্ড চালু প্রক্রিয়াধীন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, জনবল সংকটে পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
চাহিদাপত্র অনুযায়ী হাসাপাতালে মোট ৭৬ জন ডাক্তারের মধ্যে রয়েছেন ৪৪ জন। মোট ১৬৫ জন নার্সের মধ্যে দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র ৩৯ জন। নার্সিং সুপারভাইজারের ৮ জনের মধ্যে একজনও নেই। এদিকে আউটর্সোসিংয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন ঢাকার মাছরাঙ্গা নামের ঠিকাদারী একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান ৩৭৭ জন আউটসোর্সিং জনবলের মধ্যে লোক নিয়োগ করেছে ৯০ জন। এরা হলো- ৩০ জন পরিচছন্নতা কর্মী, ৯ জন নিরাপত্তা প্রহরী, ১১ জন আয়া, ৩ জন বাবুর্চি, ৬ জন সহকারী বাবুচি, ৫ জন লিফটম্যান, ১৫ জন ওয়ার্ডবয়, ২ জন ইলেকট্রিসিয়ান, ২ জন পাম্প অপারেটর, ২ জন মালী, ৪ জন ল্যাব-অ্যাটেনডেন্ট ও ১ জন ডোম। স্বল্প সংখ্যক আয়া, সুইপার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কারণে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষের সামনের টাইলস খসে পড়ছে। দরজার হাতলও ভেঙে গেছে। দরজার কাঠের জোড়া ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ-নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় দেওয়ালের টাইলস খুলে পড়ছে। তদারকির অভাবে লিফট ও আশপাশে দেওয়ালে পানের পিক ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। বারান্দার বিভিন্ন গ্রিলে মরিচা পড়ছে। বিছানার পাশে এবং শৌচাগারসহ বিভিন্ন কক্ষের সামনে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
হাসপাতালের দশম তলায় মেডিসিন ওয়ার্ড চালু হলেও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে বাথরুমের করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। নোংরা বাথরুমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। খুবই নোংরা পরিবেশ আর ময়লা আবর্জনায় সেখানকার বেসিনগুলো অব্যহৃত পড়ে আছে। কলগুলো বিকল হয়ে পড়ে আছে। মেঝেতে ময়লা আজর্বনার স্তুুপ হয়ে আছে। মেডিকেল বর্জ ফেলার ড্রাম ভর্তি হয়ে নিচ দিকে পড়ে রয়েছে। অথচ আউট সোর্সিংয়ের ৩০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী তাহলে কি দায়িত্ব পালন করছে এ প্রশ্ন সকলের।
ঘাটাইল উপজেলার হরিপুর গ্রামের সাজ্জাত হোসেন এ হাসপাতালে এসেছেন তার ছোট ভাইকে নিয়ে। প্রতিবেদককে তিনি জানান, মাত্র কিছুদিন আগে এই হাসপাতাল চালু হয়েছে। অথচ এখনি ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে এ হাসপাতালের অবস্থা কি যে হয় তা কেউ বলতে পারবে না।
শহরের পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়ার রোকসানা আক্তার, আমরা হাসপাতাল চালু হওয়ার পর খুবই খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু এখন হাসপাতালের নোংরা অবস্থা দেখে খুবই হতাশ হচ্ছি। এসব ব্যপারে এখনি কঠিন পদক্ষেপ নেয়ার দাবিও জানান তিনি।
সদর উপজেলার করটিয়ার আনোয়ার হোসেন বলেন, হাসপাতাল চালুর পর কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছি না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরোপুরি সেবা চালুর দাবি জানান তিনি।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী মোঃ লাল মাহমুদ মিয়া বলেন, আমাদের আউটর্সোসিং এর সাথে সমন্বয় করেই পরিস্কার পরিছন্নতার কাজ করা হয়। জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা টাঙ্গাইল গনপূর্ত বিভাগকে মৌখিক ও লিখিত আকারে অবহিত করেছি। তারা এসে সরেজমিনে দেখে গেছেন। হয়ত অল্প কিছুদিনের মধ্যে তারা এর সমাধান দেবেন।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, স্বাস্থ্য সেবা পুরোপুরি চালু করতে পর্যাপ্ত জনবলের প্রয়োজন। জনবলের জন্য বারবার চিঠি দেওয়া হচ্ছে। জনবল পেলে পুরোপুরি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের সহসভাপতি ও টাঙ্গাইল-৫ আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বলেন, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সবই আছে। কিন্তু জনবলের কারণে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা কেউ দায়িত্ব পালন করেননি। এ কারণে সেবা পুরোপুরি চালু হয়নি।