নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলে সচেতনার অভাবে যত্রতত্র ইলেকট্রিক ও অনুমোদনহীন হাইড্রোলিক হর্ণের ব্যবহারে উচ্চমাত্রার শব্দ দূষণ বাড়ছে।শব্দের স্বাভাবিক গড়মাত্রা ৬০ ডেসিবেল হলেও টাঙ্গাইল শহরের কয়েকটি স্থানে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবেল পর্যন্ত বেড়েছে। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, উচ্চ শব্দের এ মাত্রা অব্যাহত থাকলে মানুষের শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রাসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে শব্দদূষণ কমাতে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি কোন দপ্তরের তেমন কোন উদ্যোগ নেই। তাই শব্দ দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সম্প্রতি শহরের গুরত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি স্থানে শব্দ দূষণ নিয়ে গবেষণা চালান। পরীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, শহরের নিরালা মোড়ে শব্দের মাত্র সর্বনিম্ন ৬২ ডেসিবেল ও সর্বোচ্চ ৯৮ ডেসিবেল, বেবিস্ট্যান্ডে সর্বনিম্ন ৭৪ ডেসিবেল ও সর্বোচ্চ ১০৩ ডেসিবেল, বাস টার্মিনাল (নতুন বাসস্ট্যান্ড) এলাকায় সর্বনিম্ন ৭৫ ডেসিবেল ও সর্বোচ্চ ১০৩ ডেসিবেল, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সর্বনিম্ন ৭৫ ডেসিবেল ও সর্বোচ্চ ১০৩ ডেসিবেল। শব্দের এই উচ্চমাত্রা মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরে গাড়ির হর্ণ, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানাসহ শব্দের নানা উৎসে নিয়ম মানা হচ্ছে না। শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে দিন-রাত সব সময়ই পাইলিংয়ের কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেণ্ট মেশানোর যন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। আবদ্ধ কোন স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী- আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় এ মাত্রা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল থাকবে।
হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করা আছে। বিধি অনুযায়ী সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজের নানা যন্ত্র চালানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু টাঙ্গাইল শহরে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা বলে কিছুই নেই।
বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন, রফিক মিয়া, মোশারফ হোসেনসহ কয়েক ছাত্র জানান, তাদের স্কুলের সামনে জেলা সদর সড়ক, পেছনে প্রধান সড়ক ও পার্ক বাজার। এসব এলাকার যানবাহনের হর্ণের উচ্চ শব্দের কারণে ক্লাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে পৌর উদ্যানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাইকের শব্দেও ক্লাস করতে কষ্ট হয়। শব্দদূষণ রোধে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি প্রত্যাশা করেছে।
টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকার মনির হোসেন, সাদ্দাম মিয়া, রাহাত খান, আফজাল হোসেনসহ অনেকেই জানান, রাত-দিন প্রায় ২৪ ঘণ্টাই বাস, ট্রাক, সিএনজি ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনের হর্ণের উচ্চমাত্রার শব্দে ওই এলাকায় বসবাস ও দোকানপাট করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পাশের সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের রোগীদের ভোগান্তি হয় সবচেয়ে বেশি।
ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ও গবেষক নাজিয়ান নুসরাত অর্থি এবং হৃদয় চন্দ্র জানান, টাঙ্গাইল শহরের গুরত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি স্থানে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় বিভিন্ন যানবাহনের হর্ণ ও মাইকিংয়ের উপর তারা গবেষণা কর্ম চালিয়েছেন।
শব্দদূষণ নিয়ে কাজ করার সময় সাউন্ড প্যারামিটারে তারা যে ফলাফল পেয়েছেন- তা মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শহরের বাস টার্মিনাল (নতুন বাসস্ট্যান্ড) ও নিরালার মোড়ে শব্দদূষণ বেশি হয়। বাসটার্মিনাল এলাকায় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া আশেপাশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালও রয়েছে।
ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, বিভিন্ন জায়গায় শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা আছে- যা স্বাস্থ্যসম্মত। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকাসহ এর আশেপাশে শব্দদূষণের নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করেছে। এতে আবাসিক এলাকার মানুষের ক্ষতি ও শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে মানুষের মনজাগতিক পরিবর্তন হয়। মেজাজ খিটখিটে ও মানুষ বদমেজাজি হয়। ফলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। শব্দদূষণ প্রতিনিয়ত হলে আমরা শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।
তিনি আরও জানান, রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি, বাস ও ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে ইলেকট্রিক বা হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহার করা হচ্ছে। একজন মানুষ যখন রাস্তায় চলাচল করেন এইসব যানবাহনের হর্ণে কান পাতা দায় হয়ে যায়। রাস্তায় যে সব ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন- শব্দদূষণ তাদের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের নাক, কান, গলা বিষেশজ্ঞ ডা. এসসি পন্ডিত জানান, বর্তমানে আবাসিক ও শিল্পকারখানা এলাকা সবই এক হয়ে গেছে। অতিরিক্ত শব্দ দূষণের ফলে মানুষ কানে কম শুনছে। বার্ধক্য জনিত কারণেও মানুষ কানে কম শোনে। তবে শব্দ দূষণের কারণে মানুষ জীবনের অর্ধেক সময়ে কানে কম শুনছে। হাসপাতালে প্রতিদিন ১০০-১২০ জন রোগীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কানে কম শোনা রোগী আসেন। আবার অনেকেই কানে ব্যথা বা কান দিয়ে পুজ, পানি পড়ে এমন রোগীও আসেন।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন জানান, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি মালা ২০০৬ অনুযায়ী শব্দের মানদণ্ড বেধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে মানদণ্ডের অনেক বেশি ব্যবহার হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনার অভাবের কারণে যত্রতত্র হর্ণ ব্যবহার করছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা ফেরাতে অ্যাওয়ার্নেসমূলক অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। শব্দ একটি নীরব ঘাতক, এটি মানুষকে বোঝানো হচ্ছে। যত্রতত্র হর্ণ ব্যবহারেও সতর্ক করা হচ্ছে। কেউ না মানলে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।