নিজস্ব প্রতিবেদক: একদিকে ঈদ, অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী মেলা- এই দুই উৎসবের আনন্দে শ্বশুরবাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুরের আশেপাশের কয়েক গ্রামের জামাইয়েরা। মেলার সময় শাশুড়ির দেওয়া টাকা দিয়ে মেয়ে জামাইরা মেলা থেকে সবার জন্য খাবারসহ বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকেটা করছেন।
এই রসুলপুর গ্রামে মঙ্গলবার শুরু হয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন একটি মেলা; স্থানীয়দের দাবি, ব্রিটিশ আমলে শুরু হওয়া এই বৈশাখী মেলা বহু দশক ধরেই সবার কাছে ‘জামাই মেলা’ নামেই পরিচিত।
মেলা কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসেম জানান, সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ রসুলপুরে তিনদিনব্যাপি এই মেলা বসে। মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের অন্তত ৩০ গ্রামের জামাইয়েরা শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসেন। তারাই মেলার মূল আকর্ষণ। সব মিলেয়ে বিভিন্ন গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়।
তিনি জানান, এবারও এ মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। মানুষের ঢল নেমেছে রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। এ মেলা চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। তিনি আরো জানান, ঐতিহ্য অনুযায়ী মেলার সময় শাশুড়িরা মেয়ের জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে জামাই মেলা থেকে সবার জন্য বাজার করেন। এ কারণেই মেলাটি ‘জামাই মেলা’ হিসেবে পরিচিত।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, এই মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন দোকানিরা। তারা খাবারের দোকান, মিষ্টিজাতীয় পণ্যের দোকানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলনা, প্রসাধনীর দোকানও দিয়েছেন মেলায়। এ ছাড়াও মেলায় একাধিক ফার্নিচারের দোকানও বসেছে। বড়দের পাশাপাশি ছোট ছেলেমেয়েরা এই মেলা উপভোগ করছে।
রসুলপুর গ্রামের প্রবীণ হাফেজুর রহমান বলেন, “আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও দাদার কাছে এই মেলার কথা শুনেছি। বাড়ির মেয়ের জামাইরা মেলাকে কেন্দ্র করে বাড়ি আসায় ও মহাসড়কের পাশে হওয়ায় মেলাটি প্রতি বছর জমে উঠেছে। এটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও বড় মেলা।”
জামাল মিয়া ও নাদিম সরকার নামের গ্রামের দুই জামাই বলেন, প্রতিবছরই তারা শ্বশুরবাড়ি থেকে মেলায় আসার দাওয়াত পান। এই মেলা তাদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। মেলাকে কেন্দ্র করে অনেক আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়, তাদের সাথে ভাববিনিময় হয়। সব মিলিয়ে তারা মেলার দিনগুলি আনন্দে মেতে ওঠেন।
রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা কথা সাহিত্যিক রাশেদ রহমান বলেন, ‘এই মেলার বয়স দেড় শতাধিক বছর হবে। এ এলাকার মানুষের কাছে ঈদ বা পূজাপার্বণের মতোই এই মেলা উৎসবের। মেলা সামনে রেখে রসুলপুর ও এর আশপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাদের স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর মেলা উপলক্ষে জামাইকে বরণ করে নেওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়িরাও বেশ আগে থেকেই নেন নানা প্রস্তুতি। বাড়ি ঘর সাজানো হয় নতুন করে। জামাইদের বিশেষভাবে আপ্যায়নে বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় পিঠা পুলি।
মেলা ঘিরে এখানকার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারাও মৌসুমি ব্যবসায়ী হয়ে কিছুটা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। পাশ্ববর্তী বড় বাসালিয়া গ্রামের আকড়ি (মিষ্টি জাতীয় খাবার) ব্যবসায়ী কায়সার হোসেন বলেন, এমনিতে আমি রডমিস্ত্রির কাজ করি। মেলা আসলে একটু বাড়তি লাভের আশায় কয়েক বছর যাবত আকড়ি বিক্রি করি। বর্তমানে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা দরে আকড়ি বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা ভালই হচ্ছে। অন্যান্য মেলার চেয়ে এই মেলা অনেক নিরাপদ।
অপর ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী বলেন, এটি টাঙ্গাইল জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। দুপুর থেকেই নারী পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মেলায় ভিড় করছে। তারা বিভিন্নভাবে মেলা উপভোগ করছেন।
মেলা কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসেম বলেন, এবার মেলায় দুই শতাধিক দোকান বসেছে। এই মেলায় মিষ্টি জাতীয় খাবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। মেলায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রসুলপুরসহ আশেপাশের গ্রামের যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করা হয়েছে। মেলার পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে তারা দায়িত্ব পালন করছে।